তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনাগুলো ঘটেনি৷
দুই দশক
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০০৫-০৬ সালে৷ ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন এবং ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তবে আরেক মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে দুই দশকে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চার হাজারের বেশি৷
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
সেসময় ক্রসফায়ার নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের৷ ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়৷ সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুচ্ছেদে ৫.২ নং অঙ্গীকারে বলা হয়েছিল, ‘‘বিচারবিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে৷’’
কথা রাখেনি সরকার
ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে ২০০ জনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে মারা গেছেন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ৷ (২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ছবি)
নির্বাচন ও ক্রসফায়ার
আসক এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ নির্বাচনী বছর ও তার আগের বছরে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিমাসে গড়ে ২৭ জন বা মোট ৩২৯ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ ২০১৮ সালের ৪৬৬ টি ঘটনা ঘটে যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি৷ ২০১৯ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩৮৮ টি৷
২০২১ সাল নিম্নমুখী
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২২২টি৷ সেখানে গত বছর এমন ঘটনা ঘটেছে মোট ৮০টি৷ এর মধ্যে ৩০টির সঙ্গে জড়িত র্যাব, ২৪টিতে পুলিশ, দুইটিতে র্যাব ও পুলিশ এবং ১৭টি ঘটনায় বিজিবির নাম এসেছে৷ ৪৮টি ক্ষেত্রেই গেপ্তারের আগে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে৷
নানা নাম
তবে এগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকার করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ কখনও ক্রসফায়ার, কখনও বন্দুকযুদ্ধ কখনওবা এনকাউন্টার হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়া হয় বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে৷ সম্প্রতি র্যাব দাবি করেছে তাদের সদস্যদের সঙ্গে ‘ধস্তাধস্তিতে’ গাজীপুরে এক ব্যক্তি মৃত্যু হয়েছে৷
একরামুল হত্যা
২০১৮ সালে ২৬ শে মে র্যাবের ‘মাদক বিরোধী অভিযানে’ কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরামুল হক৷ কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর র্যাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনায় একরামুলের পরিবার মামলা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷
মেজর সিনহা হত্যা
বাংলাদেশে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা৷ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন৷ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো শতাধিক এমন হত্যার অভিযোগও রয়েছে৷
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ এই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগের পাঁচদিনে ‘ক্রসফয়ারে’ পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ কিন্তু এরপর আর এমন ঘটনা ঘটেনি৷
সরকারের বক্তব্য
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু হয় না বলে বারবারই দাবি করে আসা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে৷ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও সরকার এই কথা জোর দিয়ে বলে আসছে৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে৷’’