তারকা মানেই সমান্তরাল সংস্কৃতি নয়
৭ আগস্ট ২০২০'সমান্তরাল সংস্কৃতি’ কথাটির মধ্যে একটি মজা আছে৷ প্রশ্ন তৈরি হয়, কাকে সমান্তরাল বলা হবে? পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, এমনকী ভারতের গত ৭০ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, আজ যা মূলস্রোতকে শাসন করছে, এক সময় তা-ই সমান্তরাল ছিল৷ এই লেখায় সেই ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতেই হবে৷ কিন্তু তার আগে বলে নেওয়া ভাল, কেন হঠাৎ এই করোনা-কালে সমান্তরাল সংস্কৃতির প্রসঙ্গটি উঠল৷
গত ১০০ বছরে এমন প্যানডেমিক দেখেনি বিশ্ব৷ দীর্ঘ লকডাউন একুশ শতকের প্রজন্ম কল্পনাই করতে পারেনি৷ কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিতেই হয়৷ গৃহবন্দি হতে হয়েছে সকলকে৷ আর তার ল্যাজ ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির মঞ্চ৷ ফেসবুক তো বটেই, ইনস্টাগ্রাম, ব্যান হওয়ার আগে পর্যন্ত টিকটক প্রতিভার বিচ্ছুরণে ফেটে পড়েছে৷ বস্তুত, নেটিজেনরা (ইন্টারনেট ব্যবহারকারী) একটি নতুন শব্দই তৈরি করে ফেলেছেন-- সোশ্যাল মিডিয়া স্টার৷ আরও স্পষ্ট করে বললে, টিকটক স্টার, ইনস্টা স্টার, ইত্যাদি৷
কারা এই তারকার দল? তালিকায় বলি-টলি-ক্রিকেটের বিগ বসরা যেমন আছেন, তেমনই রয়েছেন একেবারে অজানা, অচেনা তরুণ তুর্কিরা৷ না, তাঁরা রাণু মণ্ডল নন৷ একটা গান গেয়ে আচমকা বিখ্যাত হয়ে যাননি৷ ইনস্টা, টিকটকে রীতিমতো ফ্যান ফলোয়িং তৈরি করে ফেলেছেন৷ একই সঙ্গে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টিকটকে নিজেদের ভিডিও শেয়ার করেন তাঁরা৷ বস্তুত, ভারতে টিকটক ব্যান হয়ে গেলেও এই স্টাররা কিন্তু এখনও বর্তমান৷ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন তাঁরা৷
কী করেন এই স্টাররা? কেউ নাচেন৷ কেউ গান করেন৷ কেউ রঙ্গতামাশার আসর জমান৷ আবার বিউটি টিপস দিয়ে, যোগ ব্যায়াম শিখিয়ে, অথবা নিছক গল্প বলে তারকা হয়েছেন অনেকে৷ একটা হিসেব দিলে বোঝা যাবে তাঁদের জনপ্রিয়তা৷ ব্যান হওয়ার আগে ভারতে জনপ্রিয় টিকটক স্টার ছিলেন নিশা গুরাগেইন৷ তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা দুই কোটি ১৭ লাখ৷ ১৩৭ কোটির দেশে সংখ্যাটা নেহাত ফেলনা নয়৷ আরিশফা খানের জায়গা নিশার পেছনেই৷ ফলোয়ার দুই কোটি৷ জান্নাত জুবেইর, অবনীত কউর, সমীক্ষা সুদ, আশিকা ভাটিয়া-- সকলেরই ফলোয়ারের সংখ্যা কোটির ওপর৷ ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সোশ্যাল মিডিয়ার এই তরুণ তুর্কিরা কি
সমান্তরাল সংস্কৃতির আমদানি ঘটালেন এই করোনা সময়ে? ভবিষ্যৎ সংস্কৃতির চাবিকাঠি কি তাঁদের হাতে?
ফলোয়ারের সংখ্যা যাঁদের কোটির ওপরে, তাঁদের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে ভাবে তাঁরা জনপ্রিয় হচ্ছেন, তা কি নতুন কিছু? নাকি পুরনো পানীয় নতুন বোতলে ভরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপণন করা হচ্ছে৷ অর্থাৎ, নতুন তারকারা অধিকাংশই প্রচলিত মূলস্রোতের সংস্কৃতিকেই ব্যবহার করছেন তাঁদের বিনোদনে৷ যদি তা-ই হয়, তা হলে তাকে সমান্তরাল সংস্কৃতি বলা হবে, না কি জনপ্রিয় হওয়ার সমান্তরাল মাধ্যম বলা হবে, সে প্রশ্ন থেকে যায়৷ তবে একটি ডিসক্লেমার এখানে দিয়ে রাখা ভাল৷ নতুন তারকাদের কেউই নতুন কিছু করছেন না, এমনটা বলা যায় না৷ বস্তুত, করোনার আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এক ধরনের রাজনৈতিক অর্থবাহী কমেডি৷ স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদের জনপ্রিয়তা এতটাই যে, সরকারও তাঁদের নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হয়৷ মূলস্রোতের মিডিয়ায় তাঁরা খবর হন৷
'৯০ এর দশক৷ স্কুলে পড়ি৷ বন্ধুদের হাতে হাতে ঘুরছে একের পর এক বাংলাদেশি ব্যান্ডের ক্যাসেট৷ মাইলস, ফিডব্যাক ঘরে ঘরে বাজছে৷ জেমস, আইয়ুব বাচ্চুরা তখন কলকাতার তরুণদের আইডল৷ সেলাই দিদিমণিকে নিয়ে যে গান বাঁধা যায় সে ধারণাই তখন ছিল না প্রচলিত সংস্কৃতিতে৷ তারই মধ্যে আধুনিক বাংলা গানে কার্যত বিপ্লব ঘটালেন সুমন চট্টোপাধ্যায়, অধুনা কবীর সুমন৷ সুমন লিখছেন, 'সুমন চাটুজ্জের একঘেয়ে সুর নয়', আর তরুণ-যুবকরা পাল্টা জবাব দিচ্ছেন, 'এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই'৷ সুমনের ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে হটকেকের মতো৷ দোকানের শোকেসে একই সঙ্গে সাজানো ইন্দ্রনীল সেনের আধুনিক বাংলা গানের রিমেক অ্যালবাম৷ শম্পা কুণ্ডু, শ্রীকান্ত আচার্যরাও ক্যাসেট বার করছেন৷ সে সব ক্যাসেটের বিক্রিও ছিল যথেষ্ট৷ তাঁরাও সে সময়ের তারকা৷ কিন্তু নব্বই দশকের লেজেন্ড সুমন৷ প্রচলিত গানের ভাবনাকে ভেঙেচুরে নতুন আঙ্গিক তৈরি করে দিয়েছিলেন৷ বাংলা আধুনিক গানের সমান্তরাল সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷ সে পথ বেয়েই বাজারে নামছেন নচিকেতা, অঞ্জন, শিলাজিৎ৷ আর অন্য দিকে বাংলাদেশের ব্যান্ড সংস্কৃতি আর সুমনের নগর-ভাষা মিলেমিশে ছড়িয়ে পড়ছে চন্দ্রবিন্দু, ক্রসউইন্ডজ, পরশপাথর, ক্যাকটাসের গানে৷ আরও পরে ভূমি এবং ফসিলস৷ সমান্তরাল সংস্কৃতি৷ এমন গান এর আগে শোনেনি বাঙালি৷ যদিও সত্তরের দশকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে মহীনের ঘোড়া এই নতুন ঘরানাই তৈরি করেছিল৷ তৈরি হয়েছিল প্রথম বাংলা ব্যান্ড৷ সমান্তরাল সংস্কৃতি৷ কিন্তু মানুষ গ্রহণ করেননি৷ ২০ বছর পরে নব্বইয়ের দশকে সেই মহীনের ঘোড়াই কাল্ট হয়ে গেল৷ তারকা নন, গৌতম চট্টোপাধ্যায় আইডল হয়ে গেলেন৷ সুমনের 'তোমাকে চাই', মহনীরে ঘোড়ার 'আবার বছর কুড়ি পর' অবশ্যই সমান্তরাল সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল৷ দশ বছরের মধ্যে যা মূলস্রোতের সংস্কৃতিতে পরিণত হবে৷ ঠিক যে ভাবে স্বপন বসু, কালীকাপ্রসাদের দোহার লোকসংগীতকে মূলস্রোতে নিয়ে আসবেন একই সময়কালে৷ তরুণ-যুবকরা দোহার শুনবেন আগে, আব্বাসউদ্দিন পরে৷
ভারতীয় সংগীতের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, সে সময় দেশ জুড়ে ব্যান্ড তৈরি হচ্ছে৷ ইউফোরিয়ার পলাশ সেন ডাক্তারি ছেড়ে গান গাইছেন৷ শুভা মুদগল মার্গ সংগীতকে মিলিয়ে দিচ্ছেন গিটার ড্রামসের ছন্দে৷ ইন্ডিয়ান ওশান প্রতিবাদের ভাষা তুলে আনছে বেস গিটার পারকাশানের অনুরণনে৷ পাকিস্তানের জুনুন, স্ট্রিংসের পাইরেটেড ক্যাসেট হাতে হাতে ঘুরছে৷ দশ বছরের মধ্যে ওই সংগীতই মূলস্রোতের সাউন্ডস্কেপ দখল করে নিয়েছে৷
বাবা-জ্যাঠাদের কাছে শুনেছি, ঠিক এ ভাবেই চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে মূলস্রোতের ব্যবসায়িক রঙ্গমঞ্চকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তৈরি হয়েছিল৷ সমান্তরাল সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সঙ্ঘ৷ বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন, উৎপল দত্তের কল্লোল, শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী মঞ্চের ধারণাই বদলে দিয়েছিল৷ এর কিছুদিন পরে বিভাস চক্রবর্তী তৈরি করবেন 'মাধব মালঞ্চ কইন্যা'৷ তখন যা আন্দোলন ছিল, ষাট বছর পরে এখন সেই গ্রুপ থিয়েটারই পশ্চিমবঙ্গে মূলস্রোত৷ অধুনা সমান্তরাল স্রোত ইন্টিমেট থিয়েটার৷
সাহিত্য জগতেও ঘটেছে একই ঘটনা৷ হাংরি জেনারেশনের আন্দোলন রবীন্দ্রযুগকে চ্যালেঞ্জ করেছে৷ কফি হাউস থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় কবিতাপত্র প্রকাশ করছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়৷ গড়ে উঠছে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন৷ গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা তখন সব চেয়ে জরুরি লেখাগুলি ছাপছেন অব্যবসায়িক লিটল ম্যাগাজিনে৷ স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন৷ কফি হাউসের প্রতিটি টেবিল কার্যত লিটল ম্যাগাজিনের কারখানা৷ সমান্তরাল সংস্কৃতি৷ এত বছর পরে যা পশ্চিমবঙ্গে মূলস্রোত৷
নাচের জগতে ঠিক এ ভাবেই সমান্তরাল সংস্কৃতি তৈরি করেছিলেন উদয় শংকর৷ ভারতীয় চলচ্চিত্রকে স্টুডিও-র ঘেরাটোপ থেকে রাস্তায় নামিয়েছিলেন সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল৷ সর্বভারতীয় চলচ্চিত্রে সেই একই পথে হেঁটেছেন শ্যাম বেনেগল, আদুর গোপালকৃষ্ণনরা৷ সমান্তরাল সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে৷ এর অনেক পরে একুশ শতকের গোড়ায় বলিউডেরবিগ বাজেট ছবিকে চ্যালে়ঞ্জ জানিয়ে ফের সমান্তরাল ছবির বাজার তৈরি করছেন অনুরাগ কাশ্যপ, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়, জোয়া আখতাররা৷ মুম্বইয়ে গোবিন্দা জমানা শেষ হলো৷ দশ বছরের মধ্যে অনুরাগদের ঘরানাই ইন্ডাস্ট্রিতে মূলস্রোত হয়ে গেল৷ বিশেষত এই নেটফ্লিক্স যুগে৷
সমান্তরাল সংস্কৃতি এক দিনে তৈরি হয় না৷ ফলোয়ারের সংখ্যায় তাকে বেঁধে রাখা যায় না৷ হিট এক জিনিস, সমান্তরাল সংস্কৃতি অন্য বিষয়৷ বাবা সায়গল, দালের মেহেন্দিকে এখন আর কেউ মনে রাখেননি৷ হিট, ফলোয়ার কোনওটাই কম ছিল না তাঁদের৷ ইয়ো ইয়ো হানি সিং হঠাৎ ফুরিয়ে গেলেন৷ দু'দিন আগেও তাঁর বাজার প্রথম দশে ছিল৷ ফলোয়ারের বন্যা ছিল৷ কেন এমন হলো? আসলে তাঁরা যে কাজ করেছেন, তা জনপ্রিয় হয়েছে কিন্তু সমান্তরাল সংস্কৃতি তৈরি করতে পারেনি৷ মূলস্রোতের প্রচলিত আঙ্গিককেই তাঁরা ব্যবহার করেছেন৷
বর্তমান সময়ে সমান্তরাল সমাজ মাধ্যমে যাঁরা আলোড়ন তুলছেন, তাঁরা হিট, সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সমান্তরাল সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে বলে এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি৷ প্রতি যুগেই সমান্তরাল কাজের বীজ রোপণ করেন দুই একজন৷ পরবর্তী প্রজন্ম সেই পথ অনুসরণ করে৷ বর্তমান সময়ে তেমন বীজ রোপণ হয়নি, এমন কথা বলা যায় না৷ তবে জল হাওয়া পেয়ে অঙ্কুর গজাতে সময় লাগে৷ সেটুকু সময় সকলেরই প্রাপ্য৷ অঙ্কুর গাছ হলে বোঝা যাবে, সমান্তরাল সমাজ মাধ্যম সত্যিই সমান্তরাল সংস্কৃতি তৈরি করতে পারল কি না৷
পুনশ্চ: পাঠক, দয়া করে এর সঙ্গে চটুল এবং গম্ভীর সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলবেন না৷ সংস্কৃতি, সংস্কৃতিই৷ যা সময়কে বহন করে৷ সময় চটুল হলে সংস্কৃতিও তাই হবে৷ মূল্যবোধের আলোচনার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনওটাই অধমের নেই৷