দীপাবলির দূষণ কেড়ে নিচ্ছে শ্বাস নেওয়ার অধিকার!
৮ নভেম্বর ২০১৮ক'দিন আগেই দেশজুড়ে যখন-তখন শব্দবাজি ফাটানোয় নিশেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত৷ রাতে দু-ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল আতসবাজি পোড়ানোর জন্য৷ বলা হয়েছিল, রাত ৮টা থেকে ১০টা, এই সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র ‘গ্রিন ক্র্যাকার্স' পোড়ানো চলবে৷ নির্দেশ অমান্য হচ্ছে কিনা, নজর রাখতে হবে পুলিশকে৷ কিন্তু কোথায় কী! দিল্লিসহ গোটা দেশে আলোর উৎসবে শব্দবাজি ফাটানো হলো দেদার৷ তা-ও রাত ১০টার পরে৷ মানা হলো না কোনো বিধিনিষেধ৷অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেওয়ার আগেই বাজারে চলে এসেছিল শব্দবাজি৷ ‘সবুজ বাজি' ঠিক কী বস্তু? তা কোথায় পাওয়া যাবে? ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছাবে কীভাবে? এমন হাজারো প্রশ্নের না মেলা জবাব নিয়েই প্রতিবারের মতো এবারও ৬ ও ৭ নভেম্বর দেশজুড়ে মহাসমারোহে পালিত হয়েছে দ্বীপাবলি৷ আলোর রোশনাই তো ছিলই, সেইসঙ্গে শব্দবাজির দাপট দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুন৷ দিল্লি ও তার আশেপাশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা নয়ডা, গাজিয়াবাদ ও গুরুগ্রামে কার্যত পরিবেশগত আপৎকালীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় দিল্লিকে ‘গ্যাস চেম্বার' আখ্যা দেয়া হচ্ছে৷ তবে, দিল্লি পুলিশ এবার সক্রিয় ভূমিকায় ছিল৷ নজরদারির জন্য ৫০ হাজার নিরাপত্তারক্ষী রাস্তায় ছিলেন৷ নিয়ম ভেঙে বাজি পোড়ানোয় বহু মামলা দায়ের করতে চলেছে তারা৷ দ্বীপাবলির রাতে ৩,৮০০ কিলোগ্রাম শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ৷ গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬ জনকে৷ দিল্লির পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতেও বাজি পোড়ানোয় বিধিনিষেধ মানা হয়নি৷ সেইসঙ্গে দক্ষিণের তামিলনাড়ু, পুদুচেরীতে শব্দবাজি পোড়ানোর সময়সীমা ছিল ভোর ৪টে থেকে ৫টা এবং রাত্রি ৯টা থেকে ১০ টা৷ কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাবে দিল্লির মতোই রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বাজি পোড়ানোর নির্দেশ ছিল৷ প্রতিটি রাজ্যেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে আম জনতা৷
উল্লেখ্য, গত ২৩ অক্টোবর এক জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে ভারতের শীর্ষ আদালত শব্দবাজি পোড়ানো বিষয়ক নির্দেশিকা জারি করেছিল৷ দিল্লি দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফেও একগুচ্ছ নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল৷ এত কিছুর পরও দীপাবলির পর রাজধানী দিল্লির আকাশ ছেয়েছে ধোঁয়াশায়৷ শব্দবাজি পোড়ানোর শুরুর দিকে, দীপাবলির দিন সকালে দিল্লির অন্তত ২৮ টি অঞ্চলে বায়ুর মানের ইনডেক্স অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছিল৷ দীপাবলির আগেই গত সোমবার শহরের দূষণ পরিমাপক ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার' (পিএম-১০) পৌঁছেছিল ৭০৭-এ৷ পিএম-২ দশমিক ৫ পৌঁছেছিল ৬৬৩ তে৷ এরপর দ্বীপাবলির রাতে দিল্লির বাতাসে দূষণের মাত্রা রেকর্ড মাত্রা ছাড়ালো৷ ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার' (পিএম-১০) টপকে গেল ৯৯৯-এর চরম সীমা৷
শুধু কি দিল্লি? শব্দবাজির দাপটে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে উত্তর প্রদেশের মেরঠে৷ মাত্র তিন বছরের শিশুর মুখে বাজি ফাটানো হয়েছে৷ শিশুটির মুখে ৫০টির বেশি সেলাই করতে হয়েছে৷
দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকে দূষণের পরিমাণসহ একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, আনন্দ বিহার ও মেজর ধ্যানচাঁদ ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স' ৯৯৯ ছাড়িয়ে গেছে৷
পূর্ব দিল্লির বাসিন্দা সুগত হাজরা মনে করছেন এবার আতসবাজি বা শব্দবাজির দাপট অনেক কম ছিল৷ তাই শব্দবাজিকে একমাত্র কারণ হিসেবে তুলে ধরা হলে বায়ু দূষণের প্রকৃত কারণগুলি নেপথ্যে রয়ে যেতে পারে, যা ভয়ঙ্কর দূষণের দিকে নিয়ে যাবে ভারতকে৷
ডয়চে ভেলেকে সুগত জানালেন, ‘‘এবার দিল্লি শহরে বাজি পোড়ানো কম হয়েছে৷ মোটামুটিভাবে আদালতের নির্দেশিকার প্রভাব দেখা যাচ্ছে৷ তা সত্ত্বেও আকাশ কালো৷ সূর্যালোক দেখা যাচ্ছে না৷ সাধারণভাবে বলা যায়, বাজি পোড়ানোর জন্য এটা হয়নি৷ অন্য কারণ আছে৷ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে পুলিশি নজরদারি কতটা ছিল, তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ ফলে দূষণের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে সেগুলির সমাধানোর পথ খুঁজতে হবে সরকার ও পরিবেশবিদদের৷''
সুগতর সঙ্গে ভিন্নমত না হলেও সম্পূর্ণ একমত নন দিল্লির শাসক দল আম আদমি পার্টির নেতা সঞ্জয় বসু৷ তাঁর কথায়, ‘‘প্রতি বছরই দ্বীপাবলির দু-একদিন আগে জনস্বার্থ মামলা হয়৷ শব্দবাজি নিয়ে নির্দেশিকা জারি হয়৷ সারা বছর দূষণ রোধে কাজ না করলে দ্বীপাবলির সময় তার প্রভাব চোখে পড়বে না৷ বাস্তবিক ঘটনা হলো, দ্বীপাবলির সময়েই উত্তর ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে খড়কুটো জ্বালানো হয়, যা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হয়৷ এটা দীর্ঘকালীন সমস্যা৷ সরকারকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে৷ ‘গ্রিন ক্র্যাকার' নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতকেও সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়ার কথা ভাবতে হবে৷''
শব্দবাজির দানব আকৃতি দিল্লিতে নজরদারির ঘেরাটোপে কিছুটা আটকা পড়েছে বলে দাবি করা হলেও কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম, শহর ও মফস্বলে তার চিহ্নমাত্র ছিল না৷ বরং বায়ু দূষণে এবার দিল্লিকে ছাপিয়ে গেছে বাঙালির শহর৷ সব মিলিয়ে আদালতের নির্দেশিকা উপেক্ষা করে দ্বীপাবলির আতসবাজি ও শব্দবাজি ফাটানোর ঘটনাকে এক কথায় ‘গণ-আদালত অবমাননা' বলা যেতেই পারে৷