দু পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ৪, ইজতেমা মাঠে প্রবেশ নিষিদ্ধ
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪আগে থেকে রাজধানীর উপকন্ঠ তুরাগ নদীর তীরে ইজতেমা মাঠে অবস্থান করছিলেন মাওলানা জুবায়েরপন্থিরা। ভোর রাতে সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে দুই পক্ষের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ ঘটনায় মামলা হবে, মামলার পর জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ তিন জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ঢাকা ও গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশ ওই মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। দুই পক্ষ মাঠ ছেড়ে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন, বাচ্চু মিয়া (৭০), তাইজুল ইসলাম (৬৫) এবং মো. বেলাল (৬০)। বাচ্চু মিয়ার বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, বেলালের বাড়ি ঢাকার দক্ষিণ খান, আর তাইজুলের বাড়ি বগুড়া। তিনজনের মধ্যে তাইজুল ইসলাম সাদপন্থি বলে জানা গেছে। অপর দুইজন জুবায়েরপন্থি।
যেভাবে সংঘর্ষের সূত্রপাত
২০ ডিসেম্বর শুক্রবার থেকে তুরাগ তীরের ইজতেমা ময়দানে পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা করার জন্য সাদপন্থি মুসল্লিরা আগেই ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সারা বছরই ইজতেমা মাঠটি জুবায়েরপন্থিদের দখলে থাকে। তারা সাদপন্থিদের মাঠ ছাড়তে নারাজ। এ নিয়ে পুলিশ দুই পক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে। বুধবার দুপুরেও এ বিষয়ে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। পুলিশ সাদপন্থিদের পাশের কামারপাড়া মাঠে জোড় ইজতেমা করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ওই মাঠটি ছোট হওয়ার কারণে সেখানে সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সাদপন্থিরা ঢাকায় ইজতেমা মাঠের পাশে জড়ো হতে থাকে।
বুধবার ভোররাত তিনটার দিকে সাদপন্থিদের একটা অংশ ইজতেমা ময়দানে ঢুকে পড়লে সেখানে অবস্থান নেওয়া জুবায়েরপন্থিদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। সাদপন্থিরা ফটক ভেঙে ময়দানে প্রবেশ করে। এ সময় জুবায়েরপন্থিরা তাদের প্রতিহত করতে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। সাদপন্থিরাও পাল্টা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকেন। এ সময় উভয় পক্ষের সমর্থকদের হাতে লাঠি ছিল। তবে ধারালো কোনো অস্ত্র ছিল কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নয় পুলিশ। এতে উভয় পক্ষের বহু মুসল্লি আহত হন। আহতদের টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে টঙ্গিতে দুইজন ও ঢাকায় একজনের মৃত্যু হয়। দুইপক্ষের অর্ধশত আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
গাজীপুরের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ভুল বোঝাবুঝির কারণে এই সংঘাত। আজকেই আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হয়ে যেত। এখন দুই মেট্টোপলিটন থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আমরা মাঠ থেকে মুসল্লিদের বের করে দিয়েছি। এখন ওই মাঠে আর কেউ নেই। আপাতত মাঠটি পুলিশের হেফাজতে।”
ইজতেমা মাঠে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
বিশ্ব ইজতেমা মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ঢাকা ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। বুধবার দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৮ ডিসেম্বর দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকায় জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো।
এদিকে কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তৎসংলগ্ন তুরাগ নদীর দক্ষিণ পশ্চিম এলাকায় যে কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বুধবার দুপুরে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ডিএমপি কমিশনার স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং-ওওও/৭৬) এর ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে ১৮ ডিসেম্বর বুধবার বেলা ২টা থেকে কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তৎসংলগ্ন তুরাগ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় যে কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো।
সংঘর্ষে প্রাণহানি সাদপন্থি মুরব্বির দুঃখ প্রকাশ
বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখল নিয়ে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন সাদপন্থি তাবলিগ জামাতের মুরব্বি মাওলানা রেজা আরিফ। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন সরকারের পাঁচজন উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে মাওলানা রেজা আরিফ বলেন, "কেউ কারো সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলবেন না, কোনো রকম ক্যাজুয়ালটি যেন না হয়, কোনো রকম মারামারি যেন না হয়, কোনো রকম সমস্যা যাতে না হয়। আমাদের সাথীরা এখনই মাঠ ছাড়া শুরু করুন। আর ওনাদের (জুবায়ের অনুসারী) প্রতি আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি, সরকারের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়েছি, আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে মাঠ ছেড়ে দিচ্ছি, ওনারাও যেন ইসলামের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে কোনো রকম সমস্যার চেষ্টা না করেন। ওনারাও যেন রাস্তার মধ্যে নেমে না আসেন এবং কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার না করেন। যে ঘটনা ঘটেছে, কে দায়ী সেটি জরুরি নয়, অবশ্যই মুসলমান হিসেবে এবং দেশের নাগরিক হিসেবে দুঃখ প্রকাশ করছি। যা-ই হয়েছে, এটা একেবারে অনুচিত হয়েছে।”
পরে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে রেজা আরিফ বলেন, "আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। আমাদের বৈঠকে যেটা হয়েছে, যারা আহত ও নিহত হয়েছেন তাদের পক্ষে মামলা করা হবে। আমাদের দুইজন সাথী মারা গেছেন। আমাদের উপরই প্রথম হামলা হয়েছে। পরে আসলে পরিস্থিতি কারো নিয়ন্ত্রণে ছিল না।”
‘সাদপন্থিদের ইজতেমা করতে দেওয়া হবে না'
ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে টঙ্গীর তুরাগ তীরে যা ঘটেছে, তারপর আর দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের সেখানে ইজতেমা করার সুযোগ না দেওয়ার দাবি তুলেছেন কাকরাইলের মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারীদের অন্যতম নেতা মাওলানা মামুনুল হক। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে এক বৈঠকে তার উপস্থিতিতেই এ দাবি তোলেন তিনি। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, "সাদপন্থিদের ইজতেমা হওয়ার আর কোনো অবকাশ এখন নেই।”
জুবায়েরপন্থিদের অন্যতম নেতা মহাখালীর দারুল উলুম হামিদিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে যে বৈঠক করেছি, সেখানে তিনি আমাদের তিনটি দাবি মেনে নিয়েছেন। আর একটি দাবির বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানিয়েছেন। তারা আমাদের তিনজন সাথীকে হত্যা করেছে। বহু সাথীকে আহত করেছে। এ কারণে সরকার তাদের মাঠ থেকে বের করে দিয়েছে। তারা রাতের আঁধারে সন্ত্রাসী কায়দায় মাঠে প্রবেশ করেছে। এটা আমরা যেমন কল্পনা করিনি, সরকারও কল্পনা করেনি। আজই তো বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। সেখানে সরকার যে সিদ্ধান্ত দিতো আমরা সেটা মেনে নিতাম। কিন্তু তার আগেই রাতের আঁধারে তারা সন্ত্রাসী হামলা করেছে।”
দু পক্ষের দায় অস্বীকার
বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষই একে অপরকে দায়ী করছে। সাদপন্থিদের দাবি, কামারপাড়া থেকে সুইচ গেট পর্যন্ত সড়কে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় রাত সাড়ে তিনটার দিকে জোবায়েরপন্থিরা তাদের দিকে ‘ইট-পাটকেল, জ্বলন্ত মশাল' নিয়ে হামলা করে। অন্যদিকে জুবায়েরপন্থিরা দাবি করছেন, ইজতেমার মাঠে অবস্থানকালে রাত সাড়ে তিনটায় ছুরি, ক্ষুর, হাতুড়ি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান সাদপন্থিরা।
জুবায়েরপন্থিদের নেতা মামুনুল হক বলেন, "আমাদের তিনজন ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। একপক্ষীয়ভাবে হামলা হয়েছে। আমরা এমন তথ্য পাচ্ছি, পেশাদার খুনীদেরসহ এ অভিযান পরিচালনা হয়েছে। এটি দুই পক্ষের সংঘর্ষ বলে সংবাদ প্রচার হচ্ছে, কিন্তু এটি একপক্ষীয় হামলা ও আক্রমণ।”
সাদ অনুসারী মুফতি মু'আয বিন নূর ইজতেমা মাঠ থেকে সাংবাদিকদের বলেন, "তাবলিগের এক পক্ষ সারা বছর এ মাঠটি ব্যবহার করে। তারা এবার যখন এ মাঠটিতে পাঁচদিনের জোড় (জমায়েত) করলেন, তখন আমরা সেখানে জোড় (জমায়েত) করার অনুমতি চাই। সরকার আমাদের দিয়াবাড়ি মাঠে জমায়েতের অনুমতি দিলেও সেটি পরিদর্শন করে দেখলাম মাত্র ত্রিশ হাজার মানুষ সেখানে সংকুলান হবে। সেখানে কোনো ইউটিলিসিট ফ্যাসিলিটি নেই। আমাদের ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ সেখানে সংকুলান হবে না।'' তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন স্থানে সাদপন্থিরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। রাত সাড়ে ৩টার দিকে কামারপাড়া থেকে সুইচ গেট পর্যন্ত সড়কে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জুবায়েরপন্থিরা তাদের ওপর ইট-পাটকেল ও জলন্ত মশাল নিক্ষেপ করে আক্রমণ শুরু করে। সেখান থেকেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।