ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতি ও দেশজুড়ে আতঙ্ক
১৮ এপ্রিল ২০১৮দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে শোরগোল চলছে৷ বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায় উঠে আসছে নানা তথ্য৷ একটি হিসেব বলছে, প্রতিদিন গড়ে ১০০টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়৷ বছরে যা ৪০,০০০-এর বেশি৷ প্রতি ১০টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে অন্তত ৪টির শিকার নাবালিকারা৷ প্রত্যেকটি ঘটনার পর সরকার ও পুলিশ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়৷ কিন্তু আইনের প্রয়োগ চোখে পড়ে না৷ ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো' বা এনসিআরবি-র ২০১৩ সালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে গোটা দেশে মোট ২৪,৯২৩ ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়েছিল৷ এরমধ্যে ২৪,৪৭০টি, অর্থাৎ প্রায় ৯৮ শতাংশ ঘটিয়েছে নির্যাতিতার পরিচিত লোকেরাই৷ কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধী লোকসভায় জানিয়েছেন, এনসিআরবি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সালে গোটা দেশে ১৩,৭৬৬জন শিশুকন্যা ধর্ষিতা হয়েছে৷
বিগত কয়েকদিন ধরে একের পর এক ধর্ষণের সংবাদ সামনে আসছে৷ উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে ১৭ বছরের মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে৷ অভিযুক্ত এলাকার শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার ও তার দলবল৷ তার রেশ কাটতে না কাটতেই জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়ায় মাত্র ৮ বছরের একটি শিশুকন্যাকে অপহরণ করে গণধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ আসে৷ তারপর একে একে গুজরাট, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ৷ প্রায় সর্বত্র৷ সাধারণ মানু্যের মনে প্রশ্ন, কোন পথে এগোচ্ছে ভারত? এদেশে কি ধর্ষণ ক্রমশ বাড়ছে? নাকি নানাবিধ ‘অবাধ' তথ্য পরিবেশনের এ যুগে তথ্য পাওয়া সহজ হয়েছে বলে বহুকাল ধরে চলে আসা একটি সামাজিক ব্যাধিকে হঠাৎ ভয়ংকর মনে হচ্ছে? দেশের সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলো কি এক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে? নাকি কেউ টিআরপি-র পেছনে ছুটছে আর কেউ কেউ শুধু ভোটবাক্সের রাজনীতিতে ব্যস্ত? এই প্রতিবেদনে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ৷
রাজধানী নয়া দিল্লিতে কর্মরত বাঙালি সাংবাদিক পল্লবী ঘোষ মনে করেন অবাধ তথ্যপ্রবাহই এখন সারা দেশের খবর এনে দিচ্ছে, যা কয়েক বছর আগেও এতটা সম্ভব ছিল না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে বলে মনে হয় না৷ বরং এই ধরনের ঘটনা প্রকাশ্যে আনার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ মিডিয়াও বেশি করে প্রচার করছে৷ এর ভালো-মন্দ উভয় দিকই আছে৷ একজন সাংবাদিক হিসেবে বহু মানুষের ফোন আসে৷ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে এখন মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে৷ ফেসবুক, টুইটারসহ সোশ্যাল সাইটেও প্রচার হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে পুলিশ, প্রশাসনের ওপর চাপ বেড়েছে৷ প্রত্যন্ত গ্রামে এমন ঘটনা ঘটলে অনেকেই এগিয়ে এসে অভিযোগ করতে ভয় পেত৷ ইদানীং ক্রমশ অভিযোগ জানানোর সাহস পাচ্ছে মেয়েরা৷ অভিভাবকদের মানসিকতা বদলাচ্ছে৷ নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের আধিকারিকরাও তা-ই বলছেন৷ অনেক বেশি অভিযোগ জমা পড়ছে বলে মনে হয় ঘটনা বেড়ে গেছে৷''
পল্লবী ঘোষ জানালেন ধর্ষণ নিয়ে শুধু রাজনীতি করার প্রবণতাও বেশ চোখে পড়ে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘কাঠুয়ার ঘটনার পর ইন্ডিয়া গেটের সামনে ক'দিন আগে এক মাঝরাতে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর মিছিলে গিয়েছিলাম৷ দেখলাম, উপস্থিত সকলেই রাজনীতি করতেই ব্যস্ত৷ সবাই নরেন্দ্র মোদী ও ভারতীয় জনতা পার্টিকে গালমন্দ করছেন৷ কেউ বলল না, ‘চলুন, মেয়েটির পরিবারের পাশে দাঁড়াই৷' অনেক পরে কিছু ছাত্র-ছাত্রী এসে বলল, ‘আমরা অযথা রাজনীতি চাই না৷ বিহিত চাই৷' তাই আশাহত হওয়ার কিছু নেই৷''
ভারতের সামাজিক অবস্থা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে অনেকের মনে৷ অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায়৷ কীভাবে নিজেদের সন্তানকে রক্ষা করবেন তাঁরা? চিন্তা বাড়াচ্ছে এনসিআরবি-র রিপোর্ট৷ সংস্থার ২০১৬-র রিপোর্ট দেখে চক্ষু চড়কগাছ! দেখা যাচ্ছে, ওই বছর আগের বছরের তুলনায় শিশুদের সঙ্গে যৌন হেনস্থার ঘটনা প্রায় ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ওই রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ সালে ১০,৮৫৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল৷ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা এবং ‘প্রোটেকশন অফ চিল্ড্রেন এগেনস্ট সেক্সুয়াল অফেন্সেস' বা পসকো আইনের ৪ ও ৬ নং ধারা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে নথিভুক্ত ঘটনার সংখ্যা ১৯,৭৬৫৷ ২০১৬ সালে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনার নিরিখে সবার ওপরে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ ২,৪৬৭, মহারাষ্ট্র ২,২৯২, উত্তর প্রদেশ ২,১১৫, ওড়িশা ১,২৫৮ এবং তামিলনাড়ু ১,১৬৯ ৷
২০১৮ সালের রিপোর্ট এখনও সামনে আসেনি৷ তবে পরিসংখ্যানটা খুব আশা জাগানোর মতো হওয়ার কথা নয়৷ ২০১৭ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট বিগত ২০১৫ ও ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানকে টপকে গেছে৷ চলতি বছরে তা আরও বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক৷
কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘প্রতীচী'-র কর্ণধার সাবির আহমেদের মতে, ‘‘আগে ধর্ষণ হতো না এমন নয়৷ দেশভাগের সময়েও আমরা ধর্ষণের ঘটনা দেখেছি৷ বেড়েছে, নাকি কমেছে তা নির্ধারণ করা মুশকিল৷ কারণ, এর কোনো ভিত্তিরেখা নেই৷ তবে, ইদানিং মহিলাদের প্রতি আগ্রাসন বেশি মাত্রায় বেড়েছে৷ শাসকের ক্ষমতা জাহির করার একটা উপায়৷ মহিলা নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশি সক্রিয়তা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলের প্রয়োজন৷ এই সমস্যার অন্যতম সমাধান হলো ধর্ষণ-আইনের সঠিক প্রয়োগ৷ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি৷ এখন দেখা যাচ্ছে, ধর্ষিতার ধর্ম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যা কখনোই কাম্য নয়৷ বিষয়টা ধর্মীয় বিভাজনের একটা প্রয়াস৷ এক্ষেত্রে বর্তমান আইনের প্রয়োগের মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব৷''
প্রবীন সাংবাদিক এবং সাংবাদিক সংগঠন ‘প্রেস অ্যাসোসিয়েশন'-এর সভাপতি জয়শঙ্কর গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘বলাৎকারের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এমন একটা দিন নেই, যেদিন শিশুকন্যার ওপর নির্যাতনের খবর আসেনি৷ গায়ের লোম খাড়া করে দেওয়ার মতো ঘটনা সামনে আসছে৷ ধর্ষণের পর হত্যা করে দেওয়ার নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে৷ গতবছর (২০১৭) ২৮,৯৪৭ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ ১৬,৮৬৩টি ঘটনা ঘটেছে শিশুকন্যাদের ওপর৷ প্রতি ঘন্টায় ভারতে ৪ জন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন৷ তারমধ্যে দু-জন শিশু৷ উন্নাওয়ে যে মেয়েটির ওপর যারা অত্যাচার হয়েছে, একবছর ধরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ অভিযুক্ত টিভিতে মুখ দেখাচ্ছে৷ আদালত সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করার পর মামলা সিবিআইকে দেওয়া হলো৷ গ্রেপ্তার করা হলো৷ মনে রাখতে হবে, এই ঘটনায় নির্যাতিতার বাবাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে৷ এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কীইবা হতে পারে৷ সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, ধর্ষিতার পাশে নয়, ধর্ষকের পাশে দাঁড়াচ্ছে পুলিশ প্রশাসন৷''
তবে পাশাপাশি তিনি মনে ধর্ষণ নিয়ে আগে রাজনীতি হয়েছে, এখনো হচ্ছে৷ তাঁর মতে, ‘‘নির্ভয়াকাণ্ডে ভারতীয় জনতা পার্টি রাজনীতি করেছিল৷ এখন কংগ্রেস করছে৷ রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরা তা করবেন৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিরোধী দল হিসেবে রাজনীতি করার পর ক্ষমতায় এলেই ভোল বদলে ফেলছে দলগুলো৷ ধর্ষণ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো, ধর্ষকদের মনে ভয় তৈরি করতে হবে৷''
শিক্ষিকা সিলভি সাহা তুলে ধরলেন ধর্ষণের খবরে সংবাদ মাধ্যমের একটি দায়িত্বহীনতার দৃষ্টান্ত৷ তাঁর মুখে উঠে এলো সমাজে যে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগেও তোলপাড় হয়, নির্দোষ ব্যক্তিও সামাজিকভাবে অপদস্থ হন, সেই বিষয়টি৷
ডয়চে ভেলেকে সিলভি সাহা বলেন, ‘‘আমার পাড়ায় এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে পসকো আইনে অভিযোগ জমা পড়েছিল৷ অভিযুক্ত শিক্ষক ও তাঁর পরিবারের জীবন তছনছ করে দিয়েছিল৷ কিন্তু পরে জানা গেল, ওই শিক্ষক সম্পূর্ণ নির্দোষ৷ দুঃখের বিষয় হলো, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সংবাদ আর পরিবেশন করল না সংবাদমাধ্যম৷ এ জন্য কোনো একটি ঘটনা নিয়ে হইচই করার পর শেষমেষ সেই ঘটনার কী হলো, তা প্রচারে আসা উচিত৷ এক্ষেত্রে মিডিয়া তার ভূমিকা পালন করে না৷''
পাঠক, আপনারা কি মনে করেন ভারত শিশুদের জন্য নিরাপদ দেশ'? মতামত জানান নীচের ঘরে৷