ধর্ষণ নিয়ে আমাদের মুখবন্ধ!
১০ জানুয়ারি ২০১৯গত ৫ তারিখে ২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়৷ আমি আবার লিখছি– দুই বছরের কন্যা শিশু৷ বস্তিতে মা-বাবা ও তিন বোনের সঙ্গে থাকতো শিশু আয়েশা৷ সেদিন বিকালেও খেলতে বের হয় শিশুটি৷ সন্ধ্যার দিকে টিনশেড বস্তির পাশের চার তলা বাড়ির সামনে আয়েশার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়৷
আর ৭ তারিখের ঘটনাটি নিশ্চয়ই আপনি পড়ে ফেলেছেন৷ ডেমরায় বাবা-মা কাজে ছিল, তখন দুই শিশুকে সাজিয়ে দেওয়ার নাম করে ধর্ষণের চেষ্টা করে ও পরে হত্যা করে৷ চিৎকারের মুখে ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে প্রথমে একজনকে গলা টিপে এবং পরে আরেকজনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়৷ শিশু দু'টি নার্সারিতে পড়তো৷ স্কুল শেষে এলাকায় দুজনে ঘোরাঘুরি করছিল৷ ঠিক সেই সময়ই তাদের সাজিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ঘরে ডেকে নেয়া হয়৷
এই ঘটনাগুলো পড়ার পর আপনাদের অনুভূতি কী জানি না৷ আমি শুধু নিজের স্তব্ধ অনুভূতি নিয়েই বসে আছি৷ আপনার অনুভূতি জানার সুযোগ ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ বা অন্যান্য প্লাটফর্ম থেকে৷ কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ভীষণ নিশ্চুপ সব সময় খইয়ের মতো ফুটতে থাকা অনলাইন প্লাটফর্ম৷ ভীষণ ক্ষোভে কয়েকজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন৷ কোন উপায়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যেতে পারে, শাস্তি কী হতে পারে এই নিয়েই বেশি আলাপ ছিল, তবে সেটি ‘দায়সারা কার্যক্রম’ বলা চলে৷ শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মতো একটি ঘটনা নিয়ে কেন আমরা রাজপথে নই– এই প্রশ্ন নিজেকেই করছি বারবার৷
এটা হতে পারে আমি গত ৫ ও ৭ তারিখের ধর্ষণ ঘটনা আজকে ৫ দিন পর খুঁজছি বলে থিতিয়ে গেছে আমাদের অনুভূতি৷ তবে আদৌ কি থিতিয়ে যাওয়ার কথা ছিল? আমাদের নিত্যদিনকার আলাপে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি নেই৷ কেন নেই?
অথচ ৩১ ডিসেম্বর রাতে নোয়াখালীর ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে ছেলে-বুড়ো সবাই বেশ সরব ছিলেন৷ এখনো এই বিষয়ে বিশ্লেষণ এবং আলোচনা-সমালোচনা চলমান৷
তবে কি ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল হতে গেলে অনেকগুলো বিষয় সামনে রেখে এগুতে হবে? আমাদের মানবমন কোন পথে হাঁটছে?
স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক যে-কোনো ঘটনা নিয়ে আমরা বেশ সরব হই৷ কারণ, এখানে পক্ষ-বিপক্ষ, দোষ, অপবাদ দেওয়ার মতো ঘটনা সহজ হয়৷ আমাদের রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক সচেতনতা অন্য যে-কোনো দেশের মানুষের চেয়ে বেশি৷ আর সরকার বা বিরোধীপক্ষের কঠোর সমালোচনার সুযোগও আমরা কেউ হাতছাড়া করতে চাই না৷ সে কারণে নোয়াখালীর ভোট নিয়ে নারী ধর্ষণের ঘটনায় আমরা সরব ছিলাম বলে দাবি করতেই পারি৷
আবার মনে হয়, ধর্ষণের বিষয়ে সরব হতে গেলে সামাজিক স্ট্যাটাসও মাথায় রাখার একটি বিষয় আসে৷ তনুর মতো শিক্ষিত নাট্যকর্মী মেয়েকে নিয়ে আমরা যতটা সরব হয়েছিলাম, টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর নিম্নবিত্ত পরিবারের রূপাকে হত্যা নিয়ে আমাদের আগ্রহ সমান ছিল না৷ আমরা এখনো প্রসঙ্গক্রমে তনুর নির্মম মৃ্ত্যু নিয়ে আলাপ তুলি৷ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতেই তুলি, কারণ, এর বিচার হয়নি বলে প্রশাসনকে প্রশ্ন করা যাবে৷ কিন্তু রূপার হত্যাকারী বা তাঁর পরিবার নিয়ে আপাত দৃষ্টে আমাদের মাথাব্যথা একটু কমই৷ এমন করে এই তিন শিশুর ধর্ষণের ঘটনা ভুলে যাবো৷ কিন্তু আমাদের মাথা থেকে পারুল কিংবা পূর্ণিমা শীলের ঘটনা মুছে যাবে না৷ অন্তত একটি রাজনৈতিক দলের ওপর ক্ষোভ প্রশমিত করতে আমরা তাদের ‘ধর্ষক’ বলে গালি দিতে পারবো৷
আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলেদের কাণ্ড নিয়েও আমরা বেশ সরব হয়েছিলাম৷ এর পেছনে কি ‘ধনীর দুলাল’, উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতি ক্ষোভ, ‘হোটেলকাণ্ড’– এসব ভাবনা কাজ করেছে?
আসলে ‘ধর্ষণ' শব্দটিই ভীষণ নারকীয়৷ তাই যখন যেখানেই একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তার সঙ্গে যুক্ত হয় হত্যাকাণ্ড, তখন আমার মধ্যবিত্ত মন কি বিবেচনা করে সেটিই মূল ভাবনা৷ আমাদের মধ্যবিত্ত মন শুধু ভাবে, ‘‘এতে আমার কী ক্ষতি, আমি তো ভালো আছি৷ এসব নিয়ে আমাকে বলতে হবে কেন!’’ এভাবেই আমরা ভয়ঙ্কর সব ঘটনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি৷ আজ নিম্নবিত্ত শিশুদের নাগাল পাওয়া সহজ বলে তাঁদের সন্তানদের ধর্ষণ ও হত্যা করে বেশ পার পেয়ে যাচ্ছি৷ কিন্তু কাল আমার বলয় থেকে আমার শিশুটি বেরিয়ে গেলে ভীষণ অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে৷ তাই আমাদের বোধহয় শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করেই নয়, ধর্ষণের বিষয়ে সর্বত্রই সচেতন, সতর্ক ও সোচ্চার হতে হবে৷