নতুন শুরু লক ডাউনেই
১ জানুয়ারি ২০২১সেই মার্চ মাস থেকে দফায় দফায় লক ডাউন, স্তব্ধ জনজীবন, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরত্বের ঘোর দুঃসময় পার করে পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হতে শুরু করে বছরের শেষে এসে৷ কিন্তু এই আপাত স্বাভাবিকের মধ্যেই রয়েছে অস্বাভাবিকতা৷ স্কুল-কলেজ এখনো খোলেনি৷ বহু অফিস, বিশেষত তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থাগুলি ‘বাড়ি থেকে কাজ' করার ব্যবস্থাই বহাল রেখেছে৷ যতদিন না কোভিড টিকা বাজারে আসছে এবং সুলভে পাওয়া যাচ্ছে, এই বন্দোবস্তই থাকবে বলে জানা গেছে৷ এর পাশাপাশি কর্মহীন হয়েছেন বহু মানুষ৷ সেটা যেমন তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পে হয়েছে, তেমনই হয়েছে সাধারণ কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে৷ ব্যাপক কর্মহানি হয়েছে পর্যটন এবং আতিথেয়তা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পেশাদারদের৷
কিন্তু এই বিপর্যস্ত পরিবেশেই আবার নতুন করে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়৷ ১২ বছর এক বহুজাতিক সংস্থায় দায়িত্ব নিয়ে, দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পর হঠাৎই চাকরিছাড়তে হয়েছিল সুনন্দ ব্যানার্জিকে৷ কারণ, তাঁর সংস্থা প্যান্ডেমিক পরিস্থিতিতে ভারত থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ সুনন্দ জানাচ্ছেন, তার প্রায় মাসখানেক লেগেছিল আচমকা কর্মহীন হয়ে পড়ার প্রাথমিক অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে৷ সুখাদ্যে আগ্রহ এবং রান্নার শখ থেকে সুনন্দ আর তার তিন বন্ধু মিলে চালু করেন এক রেস্তোরাঁ, কয়েক বছর আগে৷ সুনন্দ সিদ্ধান্ত নেন, আর চাকরির খোঁজ না করে সেই ব্যবসাকেই আরো বাড়িয়ে তোলার৷ একটি ‘ক্লাউড কিচেন' শুরু করার পাশাপাশি সম্প্রতি নতুন একটি রেস্তোরাঁও খুলেছেন তিনি এবং এখন মনে করছেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল হয়তো৷ যা-ই হোক, তখন আমি নিতে পারিনি, কারণ আমাদের মানসিকতা, যে চাকরিই নিরাপদ৷ তা ছাড়া কখনো ব্যবসা করিনি৷ যা করেছি, সেটা মজা করে৷ কিন্তু এখন আমার এটা করতে ভালো লাগছে৷ এবং ২০২১ সালের দিকে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছি৷''
টানা লক ডাউন, স্কুল বন্ধ, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, এমনকি খেলতেও বাইরে যেতে না পারার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে ছোটদের ওপর৷ অনেক বাচ্চার বাবা-মায়েরাই মনোবিদদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে বাচ্চাদের সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষিকা সুদেষ্ণা মৈত্র৷ চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি প্রতি মাসে নিজের বাড়িতে একদিনের সৃজন কর্মশালা করাতেন, যা আদতে খেলার ছলে বাচ্চাদের নানা জিনিস শেখানোর পাঠশালা ছিল৷ লক ডাউনের কারণে সেই কর্মশালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অনেক বাচ্চাই মনমরা হয়ে পড়েছিল, কান্নাকাটিও করত কেউ কেউ৷ সুদেষ্ণা মৈত্র, যিনি এখন ওদের সবার ‘গল্প দিদা', সাহায্য নিলেন প্রযুক্তির৷ অনলাইনেই ওদের গল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় শেখানোর কর্মশালা শুরু করে দিলেন৷ যার ফল, লক ডাউনের বছর শেষে ওই বাচ্চারা আগের মতোই সতেজ এবং অনেক বেশি সৃজনশীল৷ কেউ আবৃত্তিতে দড় হয়েছে, তো কেউ ছবি আঁকায়৷ কেউ গান গেয়ে মাতিয়ে দিচ্ছে, তো কেউ নাচ দেখিয়ে৷
‘‘আমি চিরকাল গল্প বলেই বাচ্চাদের ক্লাস নিতাম৷ ব্যাকরণ, যেটা বাচ্চাদের কাছে খুব কঠিন, সেটা সহজ করে দেওয়ার একটা ইচ্ছে আমার চিরকালই ছিল৷ সেই ব্যাকরণ এবং বানান, এটা নিয়ে গল্প আরম্ভ করি৷ আমার মনে হয়েছে, কেউ যদি গল্প বলে ব্যাপারটা মাথায় ঢোকাতো, অনেক সহজ হতো৷ একজন একটা চ্যাপ্টার পড়ে শোনাবে, একজন আঁকবে, একজন নাচবে— এটাতে বাচ্চারা খুব উৎসাহিত হয়৷ কে আগে পড়বে, কে আঁকবে, কে আগে নাচবে৷'' জানালেন সুদেষ্ণা মৈত্র৷ এই লক ডাউনের বছরে সেভাবেই তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন বাচ্চাদের খেলার ছলে পড়াশোনা৷ সেই সুবাদে ‘গল্প দিদা'র নিজের গল্পের ভাণ্ডারও বড় হয়েছে আয়তনে৷ তিনি নিজেও রপ্ত করেছেন ‘গুগল মিট'-এর মতো আধুনিক প্রযুক্তি৷
আরেকটা বিষয়ে বাচ্চাদের উৎসাহিত করেছেন ওদের গল্প দিদা চিঠি লিখতে অভিজ্ঞতাটা মজাদার করতে একটা নকল ডাকবাক্সও বানিয়েছেন, যেখানে নিজেদের মা-কে লেখা চিঠি পোস্ট করেছে বাচ্চারা তার পর সেই চিঠি যখন শেষ পর্যন্ত তাদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছে, শৈশবের সেই বিস্ময়ের কোনো তুলনা হয় না৷ এই ভাবেই একটা দুঃসময়ের বছর পেরিয়ে এসেছে ওরা৷ খেলতে খেলতে আর শিখতে শিখতে৷ ২০২১ কেমন হবে, কী অপেক্ষায় আছে, এখনো অজানা৷ কিন্তু ওরা নিশ্চিত অপেক্ষায় থাকবে আশা আর ভরসায় ঝলমলে রঙিন একটা চিঠির, যা গিয়ে পৌঁছবে ওদের ঠিকানায়৷