সাইপ্রাসের উত্তরাঞ্চল নিয়ে জটিলতা চলছে ৪৭ বছর ধরে৷ ১৯৭৪ সালে সংঘাতের পর থেকে তুর্কি সিপ্রিয়টরা মূলত সেই অংশেই থাকছেন৷ তুরস্ক তাদের সবদিক থেকেই সহায়তা করছে৷ তবে এই সহায়তা সেখানকার মানুষ কতটা চায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
তুর্কি সিপ্রিয়টদের এই অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে শুধু তুরস্ক৷ সেখানে যাওয়ার পরে দেখেছি আলাদা একটি রাষ্ট্র হিসেবেই কার্যক্রম চলছে অঞ্চলটিতে৷ রাজধানী নর্থ নিকোশিয়াতে, তুর্কি ভাষায় যেটির নাম লেফকোসা, সরকারি কর্মকাণ্ড চলছে, তাদের নিজস্ব পুলিশ, সেনাবাহিনী রয়েছে৷ বাড়ি বাড়ি পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ সবই রয়েছে৷ ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, পাঁচ তারকা হোটেল সর্বত্রই ব্যবহার করা যায় আন্তর্জাতিক ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড৷ জীবনযাত্রার মান সেখানে খারাপ নয়৷ ধর্মীয় গোড়ামির কোনো লক্ষণও চোখে পড়েনি৷
নর্থ সাইপ্রাসের বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের সাথে কথা বলেছি তাদের আক্ষেপ মূলত একটাই৷ তাহচ্ছে মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রা লিরার মানের বেশ অবনতি ঘটেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে৷ তাই তাদের আয় কমে যাওয়ায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে৷ এর বাইরে আর কোনো কিছু নিয়ে তাদের বিশেষ ভাবিত মনে হয়নি৷
বরং পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ভূমধ্যসাগরের তীরের শহর গির্নাতে নানা দেশের পর্যটকের আনাগোনা দেখেছি, সেখানেকার রেস্তোরাঁগুলোর খাবারের মান বেশ ভালো৷ পোতাশ্রয়ে মার্কিন, ব্রিটিশসহ নানা দেশের পালতোলা নৌকা রয়েছে যেগুলো ভেসে বেড়ায় অসাধারণ সুন্দর সাগরটিতে৷
তুর্কি সাইপ্রাসের সাধারণ মানুষের জীবনের দিকে তাকালে তাই বিভাজনটি সেভাবে বোঝা যায় না৷ তবে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন৷
আমি এবং আমার সহকর্মী অনুপম দেব কানুনজ্ঞ তুর্কি সাইপ্রাসে যাওয়ার আগেই যোগাযোগ করেছিলাম সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে৷ সে অঞ্চলে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গেলে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়৷ সেই অনুমতি আমরা সহজেই পেয়েছিলাম৷ এমনকি আমরা যে সময়টাতে ড্রোন ওড়াবো, সে সময়টাতে সেখানকার কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য এক তুর্কি সিপ্রিয়ট সরকারি কর্মকর্তাকেও নিয়োগ দিয়েছিলেন৷
আমরা সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পরই তার সঙ্গে দেখা হয়৷ তিনি শুরুর দিকে যে কথাটি বললেন সেটা অনেকটা এরকম৷ আমরা বাংলাদেশের উপর হতাশ৷ কারণ ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ আমাদেরকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর তা আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছিল৷
ব্যক্তিগত আলাপের ছলেই তিনি এটাও জুড়ে দেন, মার্কিন চাপে টিআরএনসিকে দেয়া স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল তোমাদের দেশ৷
ঘটনা সত্য, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান ১৯৮৩ সালে টিআরএনসিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অল্প সময়ের মধ্যেই সেই স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয় দেশ দুটি৷
ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে টিআরএনসির বর্তমানে কোনো ধরনের কূটনৈতিক বা অন্য কোনো সম্পর্ক নেই৷ প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশি কর্মী বা শিক্ষার্থীরা কীভাবে দেশটিতে যান? উত্তরটা জটিল৷ বাংলাদেশ থেকে শুরুতে তারা তৃতীয় কোনো দেশের জন্য পর্যটন ভিসা নেন৷ সেই দেশটি সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা কাতারের মতো কোনো দেশ হতে পারে৷ এরপর সেদেশ থেকে তারা তুরস্ক হয়ে নর্থ সাইপ্রাসের এরকান বিমানবন্দরে অবতরণ করেন৷ দুবাই বা দোহা থেকে বিমানে ওঠার সময় নতুনদেরকে দেখাতে হয় যে নর্থ সাইপ্রাসের কোনো প্রতিষ্ঠানে তারা চাকুরির নিয়োগ পেয়েছেন কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তির আবেদন গ্রহণ করেছে৷ ঢাকা বিমানবন্দরতো বটেই বাইরের বিমানবন্দরগুলোতেও নাকি কিছু চক্র টাকার বিনিময়ে টিআরএনসি যাওয়ার এই পথ সুগম করে দেয়৷
অনেক বাংলাদেশি এক্ষেত্রে একটি বিরাট ভুল করেন৷ তারা তুরস্কের উত্তরাঞ্চল বা নর্থ সাইপ্রাসে যাওয়ার সুযোগ পেলেই মনে করেন যে মূল সাইপ্রাসে পৌঁছে যাচ্ছেন৷ বাস্তবে নর্থ সাইপ্রাস বা তুর্কি অধ্যুষিত সাইপ্রাস থেকে বৈধভাবে বাংলাদেশি কর্মী বা শিক্ষার্থীরা গ্রিক সাইপ্রাস বা সাইপ্রাসের যে অংশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি, সেখানে যেতে পারেন না৷ তাই সাইপ্রাসে যাওয়ার আগে নিশ্চিত হোন ঠিক কোথায় যাচ্ছেন৷ দালালদের প্রলোভনে ভুলবেন না৷
বাণিজ্যিক দিক থেকে বিষয়টি এমন, টিআরএনসিতে কোনো পণ্য ঢোকানোর কিংবা কিছু সেখান থেকে বের করার একমাত্র বৈধ পথ হচ্ছে তুরস্ক৷ অর্থাৎ আপনি যদি টিআরএনসিতে কোনো পণ্য বানিয়ে তা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করতে চান, তাহলে সেটা প্রথমে তুরস্কে নিয়ে সেখান থেকে আপনার কাঙ্খিত দেশে নিয়ে যেতে হবে৷ একইভাবে অন্য কোনো দেশ থেকে কিছু আমদানি করতে গেলেও সেটা তুরস্ক হয়ে আসতে হবে৷ বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য টিআরএনসিতে যায়, সেটাও তুরস্ক হয়েই যায়৷
রাজনীতির কথা বলতে গেলে তুরস্কের কাছে নর্থ সাইপ্রাসের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ৷ গ্রিসের সঙ্গে দেশটির শত শত বছরের বিরোধে গত শতকে যুক্ত হয়েছে সাইপ্রাস৷ তুর্কি সাইপ্রাসে যেমন তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ প্রকট, গ্রিক সাইপ্রাসে গ্রিসের নিয়ন্ত্রণও অনেকটা একইরকম৷
আর তুরস্ক বাদে গ্রিসসহ গোটা বিশ্বের চোখে নর্থ সাইপ্রাস হচ্ছে তুরস্কের অধিকৃত একটি অঞ্চল৷ তাই সেখান থেকে তুরস্ককে হটিয়ে দুই সাইপ্রাসকে মিলিয়ে দিতেই আগ্রহী জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)৷ সেটা কবে সম্ভব হবে বলা মুশকিল৷ তবে সুযোগ পেলে তুর্কি সিপ্রিয়টরা যে মিলনের পক্ষে ভোট দেবেন সেটা ২০০৪ সালেই নিশ্চিত হয়ে গেছে৷