নারী রেজিস্ট্রার: বিচারকেরা কি বিধিমালা পড়েছেন?
১৬ জানুয়ারি ২০২১যেসব কারণ দেখিয়ে আয়েশাকে বঞ্চিত করা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রণালয় এবং হাইকোর্টের বেঞ্চ, কেউই সম্ভবত রায় দেয়ার আগে আইন মন্ত্রণালয়ের বিধিমালা পড়ে দেখেননি৷
২০০৯ সালের ১০ আগস্ট জারি করা প্রজ্ঞাপনটি ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা ২০০৯’ নামে পরিচিত৷ সরকারি ওয়েবসাইটের এই লিংকে (https://www.dpp.gov.bd/upload_file/gazettes/SRO-201-Law%20Ministry-10%20August%202009(6027-6049)M.pdf) ক্লিক করে বিধিমালাটি পড়া যাবে৷
ফুলবাড়ির দারুল সুন্নাহ সিনিয়র সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেছেন আয়েশা৷ ফুলবাড়ি পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি৷ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন৷ তাই তার নাম এক নম্বরে রেখে তিনজনের নামের একটি তালিকা ২০১৪ সালে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল স্থানীয় উপদেষ্টা কমিটি৷ কিন্তু ‘‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’’ এই কারণ দেখিয়ে আয়েশার লাইসেন্সের আবেদন খারিজ করে দেয় আইন মন্ত্রণালয়৷
এরপর আয়েশা মন্ত্রণালয়ের ঐ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যান৷ কিন্তু গত বছর ২৬ ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চও তার আবেদন খারিজ করে দেয়৷ কদিন আগে হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে৷ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘‘প্রাথমিকভাবে দুজন মুসলিম যুগলের মধ্যে বিয়ে পড়ানোই একজন নিকাহ নিবন্ধকের কাজ, যা মূলত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান৷’’ আরও বলা হয়েছে, ‘‘শহরাঞ্চলে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান না থাকায় সম্প্রতি মসজিদে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, শারীরিক কিছু পরিস্থিতির কারণে একজন নারীর পক্ষে মাসের কোনো একটা সময় মসজিদে যাওয়া সম্ভব হয় না৷ ওই সময় একজন নারী বাধ্যতামূলক দৈনন্দিন প্রার্থনা থেকেও বিরত থাকেন৷’’
এবার আসুন আইন মন্ত্রণালয়ের বিধিমালার ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় এবং হাইকোর্টের বেঞ্চের রায় বিশ্লেষণ করি৷
প্রথমে মন্ত্রণালয়ের কথায় আসি৷ ২০১৪ সালে তারা বলেছেন, বাংলাদেশের ‘বাস্তব অবস্থার’ পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়৷ ধরে নিলাম, তারা ঠিক বলছেন৷ তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ২০০৯ সালে যখন তারা বিধিমালাটি তৈরি করেছিলেন তখন কি বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ভিন্ন ছিল?
এবার আসি হাইকোর্টের বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ রায় বিষয়ে৷ বেঞ্চের দুই বিচারক বলেছেন, ‘‘প্রাথমিকভাবে দুজন মুসলিম যুগলের মধ্যে বিয়ে পড়ানোই একজন নিকাহ নিবন্ধকের কাজ৷’’ তাদের এমন বক্তব্যে মনে হচ্ছে, একজন নিকাহ নিবন্ধকের মূল কাজই হচ্ছে বিয়ে পড়ানো৷ অথচ পদবির নামটা খেয়াল করুন, ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার’৷ অর্থাৎ নিবন্ধন করাই তার মূল কাজ৷ এর পাশাপাশি তিনি হয়ত বিয়ে পড়াতেও পারেন৷ আইন মন্ত্রণালয়ের বিধিমালাতেও সেটা স্পষ্ট করা আছে৷ নিকাহ নিবন্ধনের আগে কী কাজ করতে হবে, বিধিমালায় তা ঠিক করে দেয়া আছে৷ নিজেই পড়ে দেখুন:
(১) নিকাহ রেজিস্ট্রি করিবার পূর্বে নিকাহ রেজিস্ট্রার পক্ষদ্বয়ের মধ্য়ে নিকাহ অনুষ্ঠিত হইয়াছে মর্মে সন্তুষ্ট হইবার জন্য় সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করিবেন অথবা নিকাহ অনুষ্ঠানের সময় উপস্থিত ছিলেন এমন দুইজন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবেন, তবে কনে পর্দানশীল হইলে, তৎপরিবর্তে তাহার পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত উকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে হইবে৷
(২) নিকাহ রেজিস্ট্রার স্বয়ং বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করিলে, তিনি নিকাহ রেজিস্টারের সংশ্লিষ্ট কলামসমূহ পূরণ করিবেন এবং রেজিস্টারে যে সকল ব্যক্তির স্বাক্ষর লাগিবে তাহাদের স্বাক্ষর গ্রহণ করিবেন এবং উহার পর নিজে স্বাক্ষর প্রদান করিয়া সিলমোহরাঙ্কিত করিবেন, তবে নিরক্ষর ব্যক্তির ক্ষেত্রে রেজিস্টারের নির্দিষ্ট স্থানে তাহার বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ বা টিপসহি গ্রহণ করিতে হইবে এবং একজন সত্য়ায়নকারী সাক্ষী কর্তৃক তাহার পূর্ণ নাম লিপিবদ্ধ করিতে হইবে৷
(৩) নিকাহ রেজিস্ট্রার ব্যতীত অন্য কেহ বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করিলে, উক্ত ব্যক্তি বিবাহের পনের দিনের মধ্য়ে উক্ত এলাকার নিকাহ রেজিস্ট্রারকে বিষয়টি অবহিত করিবেন এবং এইরূপ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি নিকাহ পড়াইয়াছেন তিনি নিকাহ নিবন্ধনের জন্য় রেজিস্টারে যে সকল ব্যক্তির স্বাক্ষর প্রয়োজন তাহাদেরকে সঙ্গে লইয়া সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রারের নিকট হাজির হইবেন৷
বিধিমালায় এটা স্পষ্ট যে, নিকাহ রেজিস্ট্রারের মূল কাজ হচ্ছে বিয়ে নিবন্ধন করা৷ অথচ আয়েশার বিরুদ্ধে রায় দিতে গিয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ পিরিয়ডের কারণে মেয়েদের পক্ষে মাসের একটা সময় মসজিদে গিয়ে বিয়ে পড়ানো সম্ভব না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন৷ কিন্তু নিকাহ নিবন্ধক হিসেবেতো আয়েশার মসজিদে যাওয়ার প্রয়োজনই নেই৷
তার মানে কি, হাইকোর্টের বিচারকেরা বিধিমালা না পড়েই রায় দিয়েছেন?