পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ব্যান্ড একটা যুগ
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮‘আস্তাবল’
নকশাল আন্দোলনের জোয়ার তখন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে৷ আন্দোলনের জেরেই একসময় কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সৃষ্টিকর্তা গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে৷ পুলিশের সঙ্গে রফা হয়েছিল এইরকম– হয় তাঁকে শহরের জেলে থাকতে হবে, নইলে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে অনেক দূরে৷ মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে একমুঠো গান নিয়ে শহরে ফিরে এলেন গৌতম৷ শুরু হলো মহীনের ঘোড়াগুলির জার্নি৷ খুব সহজ যাত্রা নয়৷ ব্যান্ড নিয়ে তখনো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কোনো ধারণাই নেই৷ পাশ্চাত্যের বিটলস, পিংক ফ্লয়েড, লেনন-ডিলান শুনছেন কেউ কেউ৷ কিন্তু তা যে বাংলাতেও হতে পারে, ভাবতে পারেননি কেউ৷ কিন্তু গৌতম একবগ্গা৷ গান তিনি গাইবেনই৷ এবং ব্যান্ড নিয়েই গাইবেন৷ কেনা হলো ড্রামস, গিটার, বাঁশি৷ ভাই বুলা, বন্ধু রঞ্জন, এব্রাহাম, বাপিকে নিয়ে শুরু হলো ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’৷ রাতবিরেতে মহড়া বসতো দক্ষিণ কলাকাতায় গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে৷ প্রতি রাতে বিপ্লব হতো সুরের জাদুঘরে৷
তেমনই এক রাতে ঘটল ঘটনাটা৷ সদ্য বাড়ি রং হয়েছে গৌতমের৷ সারা রাত মহড়া করার পর সকালে বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দেখেন, আলকাতরা দিয়ে বড় বড় করে কেউ পাঁচিলের গায়ে লিখে দিয়ে গেছেন ‘আস্তাবল’৷ ড্রাম, গিটারের আওয়াজে রাতে ঘুমাতে না পেরে কাজটা করেছিলেন কোনো এক প্রতিবেশী৷ গৌতম রেগে যেতে পারতেন৷ সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে লেখা মুছে দিতে পারতেন৷ সেটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু গৌতম মোছেননি৷ দীর্ঘদিন তাঁর বাড়ির বাইরে লেখা ছিল কথাটা৷ গৌতম বলেছিলেন, বিষয়টিকে তিনি কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই দেখছেন৷ বাংলা ব্যান্ডের গান শুনে কেউ তো অন্তত তাঁর অভিব্যক্তি জানিয়েছেন! সেই বা কম কী? মহীনের ঘোড়া আস্তাবল পেলো৷
সমালোচনার ঝড়
মহীনের ঘোড়ার শুরুর দিনগুলো ছিল এরকমই৷ দু-একজন হাতেগোনা মানুষ ছাড়া অধিকাংশই গালাগাল করে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছিল প্রথম বাংলা ব্যান্ডের৷ প্রথম শ্রেণির প্রচলিত দৈনিক কাগজগুলিতে একের পর এক সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশিত হচ্ছিল৷ কিন্তু মহীন থামেনি৷ চালিয়ে গেছে তাদের নতুন গানের ধারা৷ প্রায় তিন দশক পর বাংলার মানুষ যে গানকে কুর্নিশ জানাবে৷ যে গান রচনা করবে একটা নতুন অধ্যায়৷ আর তারই পাশাপাশি গিটার হাতে, কি-বোর্ড নিয়ে একাই মঞ্চ কাঁপাবেন আরেক যুগপুরুষ, সুমন চট্টোপাধ্যায়৷ অধুনা কবীর সুমন৷ একাই হয়ে উঠবেন একলা ব্যান্ড৷ বলবেন সময়ের কথা৷ গড়িয়াহাটার মোড়ের গল্প৷ আর মহীন-সুমনের সেই ঘরানাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলার একদল তরুণ গিটার হাতে নেমে পড়বেন মাঠে ময়দানে৷ একা গাইবে না, একসাথে গাইবেন৷ বাজাবেন৷ স্টেজ জুড়ে কার্নিভাল ছড়িয়ে দেবেন৷
বাংলা ব্যান্ড৷
আশির গল্প
আশির দশকে বাংলা গান থেকে কার্যত মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল তরুণ প্রজন্ম৷ নতুন গান কই? যে গান সময়ের কথা বলবে? পঞ্চাশ-ষাটের বাংলা গানে বিপ্লব এনেছিলেন সলিল চৌধুরীরা৷ সময়কে ধরার চেষ্টা করেছিলেন কথায় সুরে৷ তৈরি হয়েছিল কয়্যার৷ ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার অন্য ধারার সংগীত উপস্থাপন করেছিল৷ যুক্ত হয়েছিল গণসংগীত৷ কিন্তু আশির দশকে এসে সবই হারিয়ে যাচ্ছিল৷ গান বলতে বাঙালি বুঝছিল ‘স্বর্ণযুগে’র গান অথবা সময়ের হিন্দি ছবির গান৷ বাংলা ছবি তখন প্রায় দেখছেনই না মধ্যবিত্ত বাঙালি৷ ছবির গান শোনা তো অনেক পরের কথা৷ ইতিমধ্যেই বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে টেলিভিশন৷ তরুণের কানে তখন ‘সুপারহিট মুকাবিলা’ কিংবা ‘চিত্রহার’৷ মূলত বলিউডের বাণিজ্যিক ছবির গান নিয়ে তৈরি অনুষ্ঠান৷
তোমাকে চাই
এমনই এক সময়, নব্বইয়ের প্রারম্ভে ‘তোমাকে চাই’ নিয়ে সকলের মন জিতে নিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়৷ শুধু গাইছেন না, স্টেজের ওপর পারফর্ম করছেন৷ একাই বাজাচ্ছেন কি-বোর্ড, গিটার, মাউথঅর্গান৷ গাইছেন, কথা বলছেন, স্লোগান দিচ্ছেন মঞ্চ কাঁপিয়ে৷ বলছেন সময়ের কথা৷ গানের সুরে চলে আসছে এক কাপ চা কিংবা পাগল৷ বলছেন, দশ ফুট বাই দশ ফুটে মধ্যবিত্ত যাপনের কথা, নাবালক রিকশা ছোঁড়ার কথা৷ পেটকাটি চাঁদিয়াল, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, সুনীলের কবিতা কিংবা পান্নালালের বাঁশির কথা ঢুকে পড়ছে গানের কথায়৷
সময় বদলে দিলেন সুমন৷ বদলে দিলেন সুর, ছন্দ, কথা৷ চলন৷ ভঙ্গি৷ যাঁর পথ ধরে একে একে মঞ্চে উঠবেন নচিকেতা, অঞ্জন এবং আরো কিছুদিন পর শিলাজিৎ৷ বাঙালি শ্রোতা আবার বাংলা গানমুখী হলো৷
এবং ব্যান্ড
নতুন বাংলা গানের সেই ধারা আরো বদলে গেল একদল কলেজ পড়ুয়ার হাত ধরে৷ উপল, চন্দ্রিল, অনিন্দ্যরা তখন স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র৷ নতুন বাংলা গানের শরিক হয়ে তাঁরাও তখন লিখছেন নিজেদের গান৷ সুর করছেন৷ গাইছেন কলেজ ফেস্টে৷ সে গান যে একদিন অ্যালবামবন্দি হবে এবং ছড়িয়ে যাবে দেশ-বিদেশের বাঙালি শ্রোতার কাছে, তখনো বিশ্বাস করেননি তাঁরা৷ চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্যর কথায়, ‘‘প্রথম অ্যালবামের নাম দিয়েছিলাম ‘আর জানি না’৷ কারণ, এর পর আর কিছু হবে কিনা, আদৌ আমরা গান গাইব কি না, জানতাম না৷’’
‘‘আমাদের গান যে এত লোক শুনবে, ভাবিনি কোনোদিন৷ প্রথম দিকে খুব সিরিয়াসও ছিলাম না৷ সে কারণেই প্রথম অ্যালবামের নাম রাখা হয়েছিল ‘আর জানি না’৷ এরপর আর অ্যালবাম হবে, ভাবিওনি কোনোদিন৷’’
ব্যান্ডের গান শ্রোতা নিল৷ শুধু নিল না, গিলল৷ একের পর এক অ্যালবাম বেরোতে শুরু করল চন্দ্রবিন্দুর৷ অন্যদিকে আরেক অনিন্দ্য, অনিন্দ্য বোসের কলমে তখন ‘পরশপাথর’৷ তাঁর লেখা গানের ডালি নিয়ে মঞ্চ দাপাতে শুরু করল ‘পরশপাথর’-এর বাকি সদস্যরা৷ অনিন্দ্যঅবশ্য একেবারে প্রথম পর্বেই ‘পরশপাথর’ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ অনেক পরে তাঁর কলম আবার শোনা যাবে ‘শহর’ ব্যান্ডের মাধ্যমে৷ এদিকে ‘অভিলাষা’ শোনাচ্ছে তখন রাস্তার গান৷ ক্যাকটাসের সিধু-পটা জুটি স্টেজ ছেড়ে ছবিতেও নেমে পড়েছে৷ ‘নীল নির্জনে’ গানের জন্যই হিট হয়ে গেল৷ পাড়ায় পাড়ায় প্রতিদিন তখন ব্যান্ডের শো৷ পার্ক স্ট্রিটের ‘সাম প্লেস এলস’ পাবের ইংরেজি ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ‘ভূমি’ তৈরি করছেন সুরজিৎ, টুকি, সোমিত্ররা৷ গাইছেন লোকগান৷ গানের তালে তালে হেড ব্যাং হচ্ছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেস্টে৷ গিটার কাঁধে কলকাতার রাস্তা দাপাচ্ছে কলেজ পড়ুয়া তরুণেরা৷
অন্য দেশের প্রভাব
সে সময়ের কলেজ পড়ুয়া, অধুনা কলেজের শিক্ষিকা এবং বাংলা ব্যান্ডের গবেষক সংযুক্তা রায়ের কথায়, ‘‘ব্যান্ডের সেই রমরমা সময়ের কথা বলতে গেলে আমরা অনেক সময় আশপাশের কথা ভুলে যাই৷ শুধুমাত্র আটকে থাকি মহীনের ঘোড়া কিংবা সুমন-নচি-অঞ্জন-শিলাজিতের কথায়৷ আমরা ভুলে যাই, বাংলাদেশের ফিডব্যাক, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস কিংবা পাকিস্তানের জুনুন কিংবা স্ট্রিংসের কথা৷ মনে থাকে না ইউফোরিয়ার কথা৷ আসলে উপমহাদেশে সেটা ব্যান্ড যুগ৷ বাংলাদেশের ব্যান্ড, পাকিস্তানের ব্যান্ড বিপুলভাবে প্রভাব ফেলেছিল ভারতীয় সংগীতে৷ পেশায় ডাক্তার পলাশ সেন দিল্লিতে তখন ‘ইউফোরিয়া’ নিয়ে মাতাচ্ছেন৷ সেই জোয়ারও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে লেগেছিল৷ আমাদের ব্যান্ডগুলো ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল সেসব গানেও৷ আরও একটু পর ‘শহর’ কিংবা ‘ফসিলস’এর গানে সেই ধারণা পাওয়া যাবে৷’’
দোহার
আবার একেবারে অন্য এক ধারা তখন তৈরি করছেন কালিকাপ্রসাদ৷ কীর্তন, বাউলের দলের গান নতুন ফর্মে তিনি নিয়ে আসছেন বাংলা ব্যান্ডের বাজারে৷ ব্যান্ডের আলোচনায় কালিকার ‘দোহার’কে আনতেই হবে৷ বহুদিন পর যিনি বলবেন, লোকগানও তো আসলে একরকম ব্যান্ড সংগীতই!
ক্যাসেট থেকে এমপিথ্রি
এলপি থেকে ক্যাসেট আসতে সময় লেগেছিল অনেকটাই৷ ক্যাসেট থেকে সিডি আসতে সময় লেগেছে প্রায় একদশক৷ মধ্যবিত্ত তখনো পছন্দের গান অ্যালবামে কিনছেন৷ গানের বাজার তখনো অ্যালবাম বিক্রি ধরেই বিচার হচ্ছে৷ কিন্তু ওয়াইটুকে পরবর্তী বিশ্ব দ্রুত বদলাতে শুরু করলো৷ বাজারের দখল নিলো ইন্টারনেট এবং পাইরেসি, যুগপৎ৷ সিডি নয়, মানুষ কিনতে শুরু করলেন সস্তার এমপিথ্রি৷ দু’পিঠে চারটে চারটে করে গান নয়, একটা এমপিথ্রি’তে ধরে যাচ্ছে কয়েকশ’ গান৷ পাইরেসি গ্রাস করল গানের বাজার৷ বহু ব্যান্ড বন্ধ হয় সেই সময়ে৷ মানুষ গান শুনছেন তাঁদের, কিন্তু অ্যালবাম বিক্রি হচ্ছে না৷ সবটাই পাইরেসিতে হারিয়ে যাচ্ছে৷
অ্যালবাম থেকে ছবি
এদিকে ততদিনে বদলে গিয়েছে বাংলা ছবির বাজারও৷ ব্যান্ডের গায়কদের কম্পোজিশন জায়গা পেতে শুরু করলো ছায়াছবিতে৷ তাঁরাই হয়ে উঠতে শুরু করলেন সময়ের প্লে-ব্যাক সিংগার, কম্পোজার৷ একসময় যে গান ছিল বিপ্লব, দু’হাজার সাল পরবর্তী সময়ে সে গানই হয়ে যাচ্ছে মূলস্রোতের বাংলা গান৷ চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, তাঁদের গানই এখন মূলস্রোতের বাংলা গান৷
বিপ্লব থেকে বাণিজ্যে
বাজার চিনতে ভুল হয়নি বাণিজ্যিক এফএম চ্যানেলগুলির৷ অ্যালবামের গান শোনানো বন্ধ করে তারা ঢুকে পড়লো বাংলা ছবির গানে৷ ফলে নতুন নতুন তৈরি হওয়া ব্যান্ডগুলো নিজেদের প্রমাণ করার জায়গা খুঁজে পেলো না৷ অনেকটাই স্তিমিত হলো ব্যান্ড জোয়ার৷ চন্দ্রবিন্দু, ফসিলসের মতো পরিচিত ব্যান্ডগুলো এখনো মাঠে ময়দানে দাপিয়ে বেড়ালেও নতুন ব্যান্ডের উত্থান আর ততটা চোখে পড়ে না ২০১৮ সালে৷ আবার একটা স্থিতাবস্থার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে বাংলা গান৷ বাংলা ব্যান্ড৷ এর শেষ কোথায়, জানা নেই অতি বড় সংগীত বোদ্ধারও৷
পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ড সংগীত নিয়ে আপনার ভাবনার কথা লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷