পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রীর লড়াই হয় কেন
৩০ অক্টোবর ২০২০সম্প্রতি চমকে দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ভগত সিং কোশিয়ারি। মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরেকে তিনি তির্যকভাবে প্রশ্ন করেছিলেন, ''এখনো করোনার কারণ দেখিয়ে মহারাষ্ট্রে মন্দিরের দরজা খুলছেন না। আপনি কি সেকুলার হয়ে গেলেন না কি?'' যে দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই বলা হয়েছে, ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং যে দেশের কোনো রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই, সেখানে সেকুলার হওয়াটা যে অপরাধ তা রাজ্যপাল কোশিয়ারি না বলা পর্যন্ত জানা ছিল না। এ নিয়ে বিরোধী প্রতিবাদ এবং রাজ্যপালের চুপ করে যাওয়া ছাড়া ঘটনা আর এগোয়নি।
বস্তুত, ভারতে রাজ্যপালদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা দলকে বাদ দিয়ে বাকি সব দলের অভিযোগ, রাজ্যপাল হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট। বিভিন্ন রাজ্যে এই পদে যাঁরা থাকেন, তাঁদের একমাত্র কাজ হলো, সেই দলের বা কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জিমতো চলা।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে নিয়েও বিতর্কের অন্ত নেই। বিরোধীদের অভিযোগ, তিনি এমন সব কথা বলেন, এমন টুইট করেন যে দেখলে ধন্ধে পড়তে হয়, এটা কি একজন সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তির কথা, না কি বিরোধী রাজনীতিকের বক্তব্য। গত ১৮ অক্টোবর রাজ্যে পুলিশিহেফাজতে একটি মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তিনি টুইটে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ''এটা তো আইন-শৃঙ্খলাহীন নৈরাজ্য।'' একই দিনে তাঁর টুইট, এটা এখন ওপেন সিক্রেট যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশের রাজনীতিকরণ করে ফেলেছেন।
এ হেন ধনখড় দিল্লি এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করার পরেও বলেছেন, ''রাজ্যে কার্যত নৈরাজ্য চলছে। সাংবিধানিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। আল কায়দা দাঁত-নখ ছড়াচ্ছে। শীর্ষ আইএএস-আইপিএস অফিসাররা রাজনৈতিক নেতার মতো আচরণ করছেন'' ইত্যাদি। একজন রাজ্যপাল যদি এই ধরনের কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উচিত রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করা। ধনখড়ের এই কথার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে জল্পনা জোরালো হয়েছে, মোদী সরকার পশ্চিমবঙ্গেভোটের আগে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে চায়। এর আগে রাজ্য বিজেপি নেতারাও তো রাষ্ট্রপতি শাসন চেয়েছেন। অমিত শাহ পর্যন্ত বলেছেন, যা অবস্থা তাতে এই দাবি উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু পুলিশি হেফাজতে একটা মৃত্যু, কয়েকটি রাজনৈতিক খুনের ঘটনা দিয়ে কি প্রমাণ করা যায়, রাজ্যে সাংবাধানিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে? এই ধরনের ঘটনা চরম নিন্দনীয়, কিন্তু ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই এরকম নানা ধরনের গুরুতর অপরাধ হয়।
শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হবে কি না সেটা অন্য প্রশ্ন, ঘটনা হলো, রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনা নতুন নয়। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে বিভিন্ন রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত লেগেছে। বস্তুত, পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী কোনো দল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকলেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের সংঘাত বাঁধবেই।
১৯৬৭ সালের ঘটনার দিকে চোখ ফেরানো যাক। রাজ্যপাল ধরমবীর। রাজ্যে প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার হলো। বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস ও সিপিআই এবং সিপিএম জোট মিলে তৈরি করল সেই সরকার। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। সরকার বছরখানেকও টেকেনি। বিল্পবী বাংলা কংগ্রেসের কিছু বিধায়ক মিলে কংগ্রেসের সঙ্গে সরকার গড়তে চাইলেন। জ্যোতি বসু বললেন, বিধানসভায় শক্তিপরীক্ষা হোক। রাজ্যপাল সেই দাবি না মেনে নতুন সরকারকে শপথে ডেকে নিলেন। তার পরের ঘটনা আরো চমকপ্রদ। রাজ্যপাল বনাম স্পিকারের লড়াই শুরু হলো।
এরপর ১৯৬৯ সালে আবার যুক্ত ফ্রন্ট সরকার। রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান। তখনও ফ্রন্টের কিছু শরিকের সঙ্গে সিপিএমের বনিবনা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় পদত্যাগ করলেন। সিপিএম কিছু শরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করতে চাইল। রাজ্যপাল সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে সরকারকে বরখাস্ত করে দিলেন।
সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তখন কেন্দ্রে ও রাজ্যে কংগ্রেস। ফলে রাজ্যপালের সঙ্গে বিরোধ হওয়ার কথা নয়। জ্যোতি বসুর দীর্ঘ মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে ও পরে বুদ্ধদেববাবুর সময়ে বেশ কয়েকবার রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধ বেধেছে।
জ্যোতি বসুর সময় রাজ্যপাল ছিলেন এ পি শর্মা। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের সুপারিশ না মেনে উপাচার্য করেছিলেন সন্তোষ ভট্টাচার্যকে। তাই নিয়ে দীর্ঘদিন সরকার বনাম রাজ্যপাল সংঘাত হয়েছে। এ পি শর্মার এক বছরের সময়কালে সিপিএম আওয়াজ তুলেছে, 'এ পি শর্মা গদি ছাড়, বাংলা ছাড়'। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল করে পাঠালেন সাবেক গোয়েন্দা প্রধান টিভি রাজেশ্বরকে। রাজ্য সরকারের ধারণা হলো, সরকার ও দলের উপর নজরদারির জন্য রাজেশ্বরকে পাঠানো হয়েছে। গোলমাল শুরু। রাজীব ক্ষমতা হারানোর পরে রাজেশ্বরেরও বিদায় নিশ্চিত করেছিল সিপিএম।
মহত্মা গান্ধীর নাতি গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল করেছিল ইউপিএ সরকার। তাঁর পাঁচ বছরের কার্যকালে বার বার রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর সংঘাত সামনে এসেছে। নন্দীগ্রামের ঘটনা নিয়ে একাধিকবার কড়া সমালোচনা করেছেন গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী, যা মানতে পারেনি রাজ্য সরকার ও সিপিএম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনজন রাজ্যপাল পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। এম কে নারায়ণন, কেসরী নাথ ত্রিপাঠী এবং জগদীপ ধনখড়। তিনজনই সরকারের সঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। তবে ধনখড়ের সময় বিরোধ যেন সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিন ধনখড় রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রীদের সমালোচনা করেন। রাজ্যপাল কোনো নির্দেশ দিলে, বৈঠক করতে চাইলে সেখানে হামেশাই সরকারি অফিসার, মন্ত্রী, এমনকী উপাচার্যরা পর্যন্ত যান না। তৃণমূল সমানে রাজ্যপালের সমালোচনা করে যায়। দুই তরফের সমালোচনায় পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছেছে। অতীতে কোনো রাজ্যপাল সম্ভবত কোনো মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্য সরকারের এরকম লাগাতার সমালোচনা করে যাননি।
কেন্দ্রীয় সরকারের সুপারিশে রাজ্যপালকে নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির মতো তিনিও কার্যত ক্ষমতাহীন প্রধান। রাজ্যপালের অবশ্য কিছু বাড়তি ক্ষমতা আছে। যেমন রাজ্য সরকারকে বরখান্ত করে ৩৬৫ ধারা জারির সুপারিশ করা। সংবিধান অনুসারে রাজ্যপাল নামেই একটি রাজ্যের প্রধান, কিন্তু আসল ক্ষমতা থাকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। এমনিতে তাঁর পদে থাকার মেয়াদ পাঁচ বছর। তবে তার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে সরিয়ে দিতে পারে। বহুদিন ধরেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই মূলত রাজ্যপাল হন। ফলে তাঁদের কাজকর্ম ও কথাবার্তা নিয়ে প্রশ্ন ও অভিযোগের অন্ত থাকে না। এমনকী এই রাজনৈতিক বিতর্কও একাধিকবার হয়েছে, রাজ্যপালের পদ কেন রাখা হবে?
রাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধান রাজ্যপাল ও প্রকৃত প্রধান মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে যদি এই ধরনের বিরোধ শুরু হয়, তা হলে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়ায় তার উদাহরণ হলো পশ্চিমবঙ্গ। এখানে প্রতিদিন রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী বনাম রাজ্যপালের রাখঢাকহীন লড়াই চলছে। এর শেষ রাষ্ট্রপতি শাসনের সিদ্ধান্তে না কি ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর, না কি নতুন রাজ্যপাল নিয়োগ হলে, তার জবাব ভবিষ্যৎ দেবে।