1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বাণিজ্যবাংলাদেশ

পাচার হওয়া টাকা কতটা ফেরানো সম্ভব?

আসজাদুল কিবরিয়া দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদক৷
আসজাদুল কিবরিয়া
২৬ জানুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশ থেকে টাকা যে নিয়মিত ভিনদেশে পাচার হয়ে যায়, তা নিয়ে কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না, এখনো নেই। যত সময় গড়িয়েছে, টাকা পাচারের পরিমাণ তত বেড়েছে।

https://p.dw.com/p/4bgfI
বাংলাদেশি মুদ্রা- টাকা
দুই বছর আগে অর্থপাচার বন্ধের উপায়, কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে গবেষণা সেল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO

বলা যায়, অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার পাশাপাশি পাচারকৃত টাকার অংকও বেড়েছে। তবে ঠিক কী পরিমাণ বা কত টাকা পাচার হয়, তার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। বিভিন্নরকম হিসেব-নিকেশের ভিত্তিতে অনুমিত কিছু সংখ্যা মেলে। যেমন: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত বছর মে মাসে বিকল্প বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরার সময় বলেছিলেন যে, ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। সে হিসেবে গড় বছরে অন্তত ২৪ হাজার কোটি টাকা করে পাচার হয়েছে। আবার ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই)-র পরিসংখ্যান দেখায় যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-২০১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। মানে, বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে পণ্য আমদানিতে অধিক মূল্য ও পণ্য রপ্তানিতে কম দর দেখিয়ে। যেহেতু টাকা পাচার পরিমাপের কোনো সার্বজনীন পদ্ধতি বা আন্তর্জাতিক মাপকাঠি নেই, সেহেতু বিভিন্ন সূচকে বিভিন্ন রকম সংখ্যা মেলে।

আবার টাকা পাচার বা পুঁজি পাচারের কোনো বৈশ্বিক অভিন্ন সংজ্ঞাও নেই। বৈধ ও অবৈধ দুভাবেই পুঁজি একদেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তরিত হতে পারে। মুদ্রামানের পতনজনিত কারণে অনেক সময় দেশ থেকে টাকা বাইরে চলে যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা ও পুঁজি নিজদেশে বৈধপথে প্রত্যাবাসন করে। আবার বৈধ উৎসে উপার্জিত আয় অবৈধপথে কিংবা কর ফাঁকি দেয়া অর্থ বৈধপথে বিদেশে যেতে পারে। তবে বৈধপথে বিদেশে যাওয়া টাকা অনেকটা সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয় দলিল-দস্তাবেজ থাকার কারণে। আর এটা টাকা পাচার হিসেবে অভিহিত করা যায় না, যদিও দেশ থেকে পুঁজি বাইরে চলে যায়। ধারণাগত অস্পষ্টতা ও তথ্যগত অপ্রতুলতার কারণেও টাকা পাচারের বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। যেমন: সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের বা বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট গচ্ছিত অর্থের পুরোটাই এদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা নয়। তারপরও ঢালাওভাবে এটা বলা হয়ে থাকে। ২০২২ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট আমানতের পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি ৩৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ ( প্রায় ৬৭০ কোটি টাকা), যা ২০২১ সালে ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। আবার প্রায় দু' বছর আগে কয়েকটি পত্রিকা ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, বিদেশি বাংলাদেশিদের অবৈধ বিনিয়োগ অনুমোদিত বিনিয়োগের নয় গুণ বেশি, যার পরিমাণ ২০২১ সাল শেষে ৩৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে ঐ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বৈধভাবে বিনিয়োগের স্থিতি ছিল প্রায় ৩৯ কোটি ডলার।

কেউ কেউ অবশ্য এটাও মনে করেন যে, বিদেশে বিনিয়োগ করার আড়ালে আসলে টাকা পাচার হচ্ছে, যদিও তা প্রমাণ করা খুব কঠিন। যেমন: গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর আলোচ্য অর্থবছরে বিদেশে বাংলাদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল তিন কোটি ২২ লাখ ডলার। এই অর্থ যেহেতু সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে ব্যাংকের মাধ্যমে বাইরে গেছে, সেহেতু এটাকে পাচার বলার কোনো উপায় নেই। বরং, যেটা জানা প্রয়োজন, তা হলো এসব বিনিয়োগের বিপরীতে বিভিন্ন সময়ে দেশে কতটুকু অর্থ মুনাফা হিসেবে প্রত্যাবাসিত হয়েছে।

পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে। সেখানে এক বছরের জন্য বিদেশে পাচার করা টাকা ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে দেশে ফেরত আনার আইনি সুযোগ দেয়া হয়। তবে অর্থবছর শেষে দেখা গেল, এ সুযোগটি কেউ কাজে লাগাননি। যারা টাকা পাচার করেছেন, তারা কেনই বা বাড়তি কর দিয়ে টাকা দেশে ফিরিয়ে আনবেন এবং পাচারকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত হতে যাবেন, সে প্রশ্নই বরং তখন উঠেছে। তাছাড়া, কেউ যদি সত্যি কিছু টাকা ফিরিয়ে আনতে চান, তাহলে তো বিকল্প একাধিক পথ আছে।

প্রথমত, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ওপর সরকারিভাবে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা রয়েছে। কাজেই পাচার হওয়া টাকার কিছু যদি এই রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আনা হয়, তাহলে উল্টো বাড়তি কিছু লাভ জুটবে। আর একেবারেই কেউ যে এই সুযোগ কিছুটা হলেও কাজে লাগায়নি, তা জোর দিয়ে বলা যায় না, যদিও এর সমর্থনে কোনো উপাত্ত নেই।

দ্বিতীয়ত, বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবেও পাচার হওয়া টাকার কিছু অংশ ফিরে আসার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের উৎস নিয়ে সাধারণত কোনো প্রশ্ন করা হয় না। ফলে বারমুডা, মরিশাস, সিশেলস ও পানামার মতো অফশোর জুরিসডিকশন বা ট্যাক্স হেভেন হিসেবে পরিচিত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ এসে থাকে, তার মধ্যে যে পাচার হওয়া টাকা নেই, তা কেই বা নিশ্চিত করে বলতে পারে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এরকম ১৫টি দেশে থেকে নিট বা প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, গত এক দশকে এরকম বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসা মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৯ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। যেমন, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে সার্বিক নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার যেখানে উল্লিখিত ১৫টি দেশ থেকে এসেছিল প্রায় ৯ কোটি ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট ৩২৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে ৬১ কোটি ডলার বা ১৯ শতাংশ এসেছে ১৫টি দেশ থেকে। তবে এই ১৫টি দেশের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুর থেকেই অর্ধেক বিনিয়োগ আসে। এসব বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে দেশ থেকে পাচার হওয়া কিছু অর্থ রয়েছে। পাচারকারীরা কেউ কেউ পানামা, কেম্যান আইল্যান্ড বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো অফশোর জুরিসডিকশনে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে বেনামী কোম্পানি খুলেছে। তারপর সেই কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ দেখিয়ে সেই টাকার কিছুটা ফেরত এনেছে। এতে লাভ হলো যে, বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে বিভিন্ন সুবিধা নেয়া। এভাবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনাকে বলা হয় রাউন্ড ট্রিপিং বা ঘুরপথে বিনিয়োগ। ভারতে মরিশাস থেকে যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তার সিংহভাগ এভাবে আসে বলে এখন এই বিনিয়োগের ওপর করারোপ করা হয়েছে।

তাহলে এ প্রশ্নটা উঠতেই পারে যে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে এই ঘুরপথে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হবে কিনা? নাকি তা করতে গেলে পাচার আরো বেশি উৎসাহিত হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর চট করে পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য দরকার এ ধরনের বিনিয়োগের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বাড়ানো।

বস্তুত অর্থনীতির আয়তন যত বাড়ে, তত টাকা পাচার হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে, যদি দেশে সুশাসনের ঘাটতি থাকে, আর্থিকখাতে অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়া হয় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে শৈথিল্য দেখা যায়। আর যারা টাকা বাইরে পাচার করেন, তারা সাধারণত তা ফেরত নিয়ে আসার প্রত্যাশায় করেন না। ফলে, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রচেষ্টা বেশ দুঃসাধ্য কাজই বটে। সর্বোপরি, তথ্য প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবন টাকা পাচারকে সহজতর করে তুলেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন বা ভার্চুয়াল মুদ্রার কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক পণ্যের বৈচিত্র্য, যা এখন টাকা পাচারের বহুমুখী পথ খুলে দিয়েছে। তাতে করে টাকা পাচার রোধ করা যেমন কঠিনতর হয়ে উঠেছে, তেমনি তা ফিরিয়ে আনাও দুরূহতর হয়ে পড়েছে।

আসজাদুল কিবরিয়া দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদক৷
আসজাদুল কিবরিয়া দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদক৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য