1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘পাস নাই স্যার, তয় প্যাট আছে’

নোমান মোহাম্মদ ঢাকা
২৩ এপ্রিল ২০২১

আমার এক হাতে এক ডজন ডিম, আরেক হাতে টাকা৷ কিছুটা হতভম্ব৷ সদাই দিয়ে টাকা না নিয়েই হঠাৎ করে দোকানের শাটার পড়ে গেল যে!

https://p.dw.com/p/3sTEF
ঢাকায় লকডাউন
ছবি: Al-emrun Garjon/AP/picture alliance

তবে আমার সামলে নিতে সময় লাগে না৷ একটু দূর থেকেই যে দেখা যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি! এদিকেই আসছে৷ ড্রাইভারের পাশে বসা পুলিশ ভাইটি হম্বিতম্বি করছেন খুব - লকডাউনে দোকান খোলা কেন? তাই রাস্তার দুপাশের দোকানের শাটার পড়ছে টপটপ৷ কিন্তু ঝাঁপ খুলে যায় সেকেন্ডের কাঁটা মিনিট পেরোনোর আগেই৷ পুলিশের গাড়িটা বেরিয়ে যেতে যতক্ষণ লাগে আর কি!

শাটার খুলে পরিচিত দোকানদারের হাসি, ‘‘দেন মামা ট্যাকা৷’’

একশ টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলি, ‘‘পুলিশের সঙ্গে তো বেশ চোর-পুলিশ খেললেন৷’’

পনেরো টাকা ফেরত দিয়ে পান খাওয়া দাঁত বের করা উত্তর, ‘‘পাতানো খেলা মামা৷ ওরাও জানে, এলাকার মইধ্যে আমরা দোকান বন্ধ করুম না৷ তা-ও একটা চক্কর দিয়া গেল আর কি!’’

এলাকার বাইরে ব্যাপারটা অমন ‘পাতানো' ছিল না অবশ্য এবারের লকডাউনে৷ মূল সড়কে উঠলেই ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা৷ ‘মুভমেন্ট পাশ' না থাকলে পথ আটকে দেয়৷ সামনে এগুনোর উপায় থাকে না৷

ভড়কে যাওয়া এক বন্ধুর তাই ফোন, ‘‘একটা মুভমেন্ট পাসের ব্যবস্থা করতে পারবি?’’

‘‘আমি কিভাবে ব্যবস্থা করবো? ওয়েবসাইটে ঢুকে নিয়ে নে৷’’

‘‘ওখানে জ্যাম লেগেছে, ঢোকা যাচ্ছে না৷ এখন কী করবো?’’

‘‘কী করবি, পরের কথা৷ কিন্তু তোর মুভমেন্ট পাস লাগবে কেন?’’

‘‘অফিস খোলা তো৷’’

‘‘তাহলে অফিসেরই না যানবাহন দিয়ে তোদের নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করার কথা?’’

‘‘আরে, ওটা সরকার বলেছে৷ বলার জন্যই বলা৷ নিজেদেরই যেতে হবে৷ না গেলে বেতন কাটা৷ এখন মুভমেন্ট পাস ছাড়া বের হলে পুলিশ কোন বেইজ্জতি করে, কে জানে!’’

তা এ দফা লকডাউনের শুরুতে অন্তত রাস্তায় চলাচলে পুলিশের কড়াকড়ি ছিল খুব৷ তেলাপোকার মতো উল্টে থাকা রিকশার সারি সে ঘোষণাই দিচ্ছিলো৷

আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম৷ জায়গাটা মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্করের কাছে৷ মেট্রোরেলের কাজের জন্য রাস্তা এমনিতেই সংকুচিত৷ সেটি আরো সরু হয়ে গেছে আকাশে এক চাকা তুলে শুইয়ে রাখা রিকশাগুলোর জন্য৷ কিন্তু পুলিশ বাহিনীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই৷ রিকশা উল্টে দেয়া পর্যন্তই তাদের কাজ৷ এরপর প্রাইভেট কারের আরোহী আর পথচারীদের নিয়ে ব্যস্ততা৷ কারো মুভমেন্ট পাস আছে, কারো নেই৷ না থাকা কেউ কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছেন জাতীয় পরিচয়পত্র, কিংবা অফিসের আইডি৷ তাতেও সামনে এগুতে না পারার দল ফোনে খুঁজছেন প্রভাবশালী পরিচিতজন৷

আমি পকেটে থাকা মুভমেন্ট পাস বাড়িয়ে দিলাম৷ এরপর সাংবাদিক পরিচয় দেবার পর পুলিশের কথা, ‘‘এটি আগে বললেই হতো৷ যান৷’’

আমি যাওয়ার আগেই ময়লাটে শার্টের এক মধ্যবয়ষ্ক মলিন মুখে এসে দাঁড়ান পাশে৷ অনুনয় করতে লাগলেন তাঁর রিকশাটা ছেড়ে দেবার জন্য৷ কিন্তু পুলিশকর্তার মন গলে না৷ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সরিয়ে দেন কয়েকবার৷ তাতেও কাজ না হওয়ায় হুঙ্কার ছাড়েন, ‘‘জানোস না লকডাউন চলতাছে৷ বাইর হইছস ক্যান?’’

‘‘স্যার, বাইর না হইয়া উপায় কী! রিকশা না চালাইলে খামু কী?’’

‘‘খাবি কী, সেটা সরকারকে জিগা৷ আমাদের উপর অর্ডার আছে পাস ছাড়া কাউরে না ছাড়ার৷ আছে তোর মুভমেন্ট পাস?’’

‘‘পাস নাই স্যার. তয় প্যাট আছে৷ হেল্লাইগাই তো রিকশা লইয়া বাইর হইছি৷’’

পুলিশকর্তার শুনলন, কী শুনলেন না৷ ব্যারিকেডের ওপারের আরেক গাড়ির দিকে ছুটলেন তিনি৷

মলিনমুখ ফিরে আসছেন নিজের ওল্টানো রিকশার পাশে৷ নাম জহির মিয়া৷ আগারগাঁওয়ে এক বস্তিতে থাকেন জানালেন৷ স্ত্রী, তিন কন্যা, এক পুত্রের সংসার৷ ‘‘বউ গার্মেন্সে চাকরি করতো৷ চাকরি চইলা গ্যাছে৷ পোলাপাইন ছুডো ছুডো৷ এখন আমি রিকশা চালাইয়া না কামাই করলে খামু কী’’-- যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলে চলেন জহির মিয়া৷

নোমান মোহাম্মদ
নোমান মোহাম্মদছবি: privat

সান্ত্বনা দিতে চাই, ‘‘কিন্তু সরকার তো সবার ভালোর জন্য এই লকডাউন দিয়েছে৷ নইলে করোনায় কত লোক মারা যেতে পারে৷’’

‘‘এগুলা ভুয়া কথা৷ আমরা মানি না৷’’

‘‘কেন?’’

‘‘ক্যান মানে? করোনায় আমরা মরতেও পারি, না-ও মরতে পারি৷ কিন্তু রিকশা চালাইতে না পারলে তো খিদায়ই মইরা যামু৷ কইতে পারেন, তয় খিদা লাগে ক্যান?’’

চমকে উঠলাম৷ অনেকদিন আগে মহিলা সমিতিতে দেখা মঞ্চনাটকের কথা মনে পড়ে গেল৷ আবদুল কাদের, যিনি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে অভিনয়ের সূত্রে ‘বদি’ নামে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলেন, তাঁর কণ্ঠেই সম্ভবত শুনেছিলাম সংলাপটি৷ তা যে জীবন থেকে নেয়া, জহির মিয়ার শূন্যতার ছুঁড়ে দেয়া শেষ কথাটায় তা বুঝতে বাকি থাকে না৷

এর প্রায় সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা৷ কড়া লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহ সেটি৷ এলাকায় আর পুলিশের টহল গাড়ি ঢোকে না৷ বন্ধুও মুভমেন্ট পাসের জন্য ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করে না৷ আমিও রিকশায় দিব্যি আবার চলে গেলাম মিরপুর ১০ নম্বরে৷ আগে যেখানে পুলিশের ব্যারিকেড ছিল, সেটি এখনো আছে৷ তবে তাদের মধ্যে মুভমেন্ট পাস চেক করার গরজটা আর দেখলাম না৷

কী জানি, বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিনা৷ নাকি এলাকার দোকানদারের ওই কথাটিই এখন সরকার-পুলিশ-জনগণ সবার জন্যই সত্য৷ করোনার বিপক্ষে যুদ্ধে এটা আসলে লকডাউনের পাতানো খেলা!