1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
সমান অধিকারবাংলাদেশ

পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরবে কীভাবে?

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির খোঁজে প্রায় ২৭ বছর আগে শান্তি চুক্তি হয়েছিল৷ কিন্তু শান্তি ফেরেনি৷ এখনও পড়ছে লাশ, ঝড়ছে রক্ত৷

https://p.dw.com/p/4l9XZ
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
শান্তিতে নোবেল পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা পাহাড়ে শান্তি ফেরানোছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে৷ এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷

সর্বশেষ খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে পিটুনিতে এক বাঙালি যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য অঞ্চল৷ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ কেন তিন পার্বত্য জেলা এমন অশান্ত হয়ে উঠলো সেটি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন৷

সংঘাত এড়াতে পার্বত্য জেলাগুলোর পাড়া-মহল্লায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের নিয়ে বৈঠক করছে জেলা প্রশাসন৷ গঠন করা হয়েছে একাধিক সম্প্রীতি কমিটিও৷

পার্বত্য অঞ্চল হঠাৎ করে অশান্ত হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন পাহাড়িরা৷ দীঘিনালার একটি স্কুলের শিক্ষক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর পাহাড়ে এক ধরনের থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল৷ আমরা আশঙ্কা করছিলাম, কিছু একটা ঘটতে পারে? পরে সেটাই সত্যি হলো৷ এলাকার বাঙালি যুবকরা অভ্যুত্থানের পর আমাদের বিগত সরকারের দোসর বানিয়ে শিক্ষা দেওয়ার কথা বাজারে বলাবলিও করেছে৷ বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরেও ছিল৷ কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ পূর্ব পরিকল্পনা না হলে খাগড়াছড়ি সদরের ঘটনা নিয়ে দীঘিনালায় কেন আগুন দেওয়া হবে? আমাদের উপজেলা তো জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে৷ আরও তো অনেক উপজেলা আছে, সেখানেও তো হতে পারত? ফলে মনে হচ্ছে, যা হয়েছে তা ছিল পরিকল্পিত৷''

শান্তি চুক্তি পুরো বাস্তবায়ন হয়নি

শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে৷ এর মূল কথা কথা ছিল, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সেজন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল৷ এর মধ্যে ছিল তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে৷ উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারকাজ এই পরিষদের অধীনে থাকবে; পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা; উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার ফিরিয়ে দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা ইত্যাদি৷

আমরা বরাবরই রাজনৈতিক নেতাদের অনাগ্রহ দেখেছি: খুশি কবীর

শান্তি চুক্তির ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সে অঞ্চলে গঠন করা হয়েছে৷ কিন্তু চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার জনসংহতি সমিতি বলছে, প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছে বটে কিন্তু সেগুলোর হাতে ক্ষমতা নেই৷ যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হচ্ছেন জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা৷ এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে৷ এছাড়া জেলা পরিষদগুলোর উপর আঞ্চলিক পরিষদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে দাবি তাদের৷

দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন অধিকার কর্মী খুশি কবীর৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ কিন্তু আমরা বরাবরই রাজনৈতিক নেতাদের অনাগ্রহ দেখেছি৷ আসলে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি৷ তাহলেও কিছুটা শান্তি সেখানে মিলতে পারে৷''

শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত ২৬ বছরে ছয়টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ে৷ এসব দল নিজেরাও অভ্যন্তরীণ বিরোধেও জড়াচ্ছে৷

অবশ্য চুক্তির ব্যাপারে সরকার দাবি করছে পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এ পর্যন্ত ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷ কিন্তু জনসংহতি সমিতির দাবি ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে৷ ১৮টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে৷ এ কারণে সুফল মিলছে না৷ 

পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন৷ এ পর্যন্ত ছয়বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেও ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধানে কোনো সফলতা আসেনি৷

তিন পার্বত্য জেলা থেকে ভূমি বিরোধ নিয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রায় ২২ হাজার দরখাস্ত জমা নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব আবেদনের সুরাহা করা হয়নি৷

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব শামিমুল হক ছিদ্দিকী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নয়৷ এখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যুক্ত৷ আমরা বিষয়টির সমন্বয় করে থাকি৷ ফলে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা এভাবে বলা মুশকিল৷ সর্বশেষ যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু ক্ষতিপূরণ আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হচ্ছে৷ উপদেষ্টা মহোদয় ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে বলেছেন৷''

একের পর হত্যাকাণ্ড, বিচার হয়নি একটিরও

সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন৷ নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি৷ বাঙালি আছেন ১ হাজার ৪৪৬ জন৷ এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন৷

আর শান্তি চুক্তি হওয়ার পরও ৮৯৯ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন৷ চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন৷

কিন্তু কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি৷

পাহাড় এখনও বৈষম্যমুক্ত হয়নি: ইলিরা দেওয়ান

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাহাড়ে যেটা হচ্ছে, সেটা শোভন নয়৷ আমরা সেখানে আর কোনো রক্তপাত দেখতে চাই না৷ আমরা এটাও চাই না যে, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কেউ মৃত্যুবরণ করুক৷ অন্তর্বর্তী এই সরকারে পাহাড়ের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা৷''

আদিবাসী নেতা ও মানবাধিকার কর্মী ইলিরা দেওয়ান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমতলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাহাড়ের ছেলেরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছে৷ আমরা তো চেয়েছিলাম সারাদেশে বৈষম্যমুক্ত একটা সরকার বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে৷ কিন্তু পাহাড় এখনও বৈষম্যমুক্ত হয়নি৷ সারাদেশের মতো পাহাড়েও দেওয়াল লিখন বা গ্রাফিতি করেছিল ছেলেরা৷ কিন্তু সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে৷ কিন্তু দেশের অন্য কোথাও তো এটা হয়নি৷ পরিবর্তনের পরও কেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আমাদের ছেলেরা মারা যাবে? আসলে বৈষম্যমুক্ত করার জন্য এখনও আন্তরিকতার ঘাটতি আছে৷ আমরা আশা করি, এখন যিনি সরকারপ্রধান তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন৷ ফলে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন৷ তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন৷''

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা দেশের সব বিষয়ে কথা বললেও পার্বত্য অঞ্চলের এই বিষয়ে তাদের খুব একটা সোচ্চার দেখা যায়নি৷ কেন তারা এই বিষয়ে নিরব? জানতে চাইলে অন্যতম সমন্বয়ক নুশরাত তাবাসসুম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ঘটনার সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন৷ এখন দেশে ফিরেছেন৷ অবশ্যই এ ব্যাপারে খোঁজ নিবেন এবং যা করা দরকার সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন৷''

আরেক সমন্বয়ক ওয়াহিদ উজ জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথম দিন থেকেই আমি নিজে এ ব্যাপারে খোঁজ রাখছি৷ পাহাড়ি ও বাঙালি ছাত্রদের সঙ্গে পৃথকভাবে আমরা কথাও বলেছি৷ তবে হ্যাঁ, মিডিয়াতে কিছু না বলার কারণে হয়ত অনেকে মনে করছেন আমরা খোঁজ রাখছি না৷ বিষয়টি এমন নয়৷ আমরা পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কঠোরভাবে চেষ্টা করছি৷''

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷