1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পিতার বদনাম ঘোচাতে চান রাহুল?‌

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কয়েক দশক আগে ভারতে রব উঠেছিল, ‘‘‌গলি গলি মে সোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়‌৷’’ এবার রাফাল চুক্তি নিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে চেপে ধরেছেন রাজীব গান্ধীর ছেলে রাহুল৷ তাঁর স্লোগান, ‘‘‌গলি গলি মে সোর হ্যায়, চৌকিদার চোর হ্যায়৷’’

https://p.dw.com/p/35ZQv
বাবা রাজীব গান্ধী ও মা সোনিয়া গান্ধীর কোলে ছোট্ট রাহুল গান্ধী৷ ছবিটি ১৯৭১ সালে তোলা৷ছবি: picture-alliance/united archives

আশি ও নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিল বোফর্স কামান৷ দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত ও সুইডেনের মধ্যে বোফর্স কামান কেনার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল৷ তাতে দু দেশের মধ্যস্থতাকারীদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছিল সরকার, এমনটাই অভিযোগ তুলেছিল সুইডিশ রেডিও৷ দুর্নীতির অঙ্কটা ছিল ৬৪ কোটি টাকা, যার জেরে গদিচ্যুত হতে হয়েছিল রাজীব গান্ধীকে৷ অনেক পরে প্রমাণিত হয়েছে, রাজীব গান্ধী ছিলেন নির্দোষ৷ পরে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয়৷ তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধী তখন নিতান্তই নাবালক৷ এখন শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেসের হাল ধরেছেন তিনি৷ প্রতি মুহূর্তে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছেন জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ তাবড় বিজেপি নেতাদের৷ রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির আঁচ পেয়েই রাহুলের মাথায় ঘুরছে বাবার (‌রাজীব গান্ধী)‌ বদনাম ঘোচানোর তাগিদ৷ দলীয় স্বার্থ তো আছেই, সেইসঙ্গে যেন বোফর্সের কালো দাগের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া তরুণ কংগ্রেস নেতা৷

বিগত কিছুদিন ধরে ভারতের রাজনীতির ময়দান কাঁপাচ্ছে যুদ্ধবিমান রাফাল৷ আসলে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে লড়াকু যুদ্ধবিমান রাফাল কেনার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷ যত বিবাদ সেই চুক্তিকে ঘিরে৷ মোটামুটি, ভারত ফ্রান্সের একটি কোম্পানি  দাঁসো অ্যাভিয়েশনের কাছ থেকে ৩৬টি রাফাল কিনতে সম্মত হয়েছে৷ বাকি বিমানগুলি ফ্রান্সের প্রযুক্তি নিয়ে তৈরি করবে ভারতীয় এক বেসরকারি সংস্থা৷ এখানেই দুর্নীতির অভিযোগ৷ মূলত ৩টি বড়বড় অভিযোগ নিয়ে দেশজুড়ে শোরগোল চলছে৷ এক, বছর দশেক আগে যে দামে ফ্রান্সের কাছ থেকে এই যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা চালিয়েছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ইউপিএ সরকার, বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকার তার থেকে প্রায় ৩ গুন দাম দিয়ে একই বিমান কিনেছে৷ ইউপিএ সরকার রাফাল কিনতে চেয়েছিল ৫২৬ কোটি টাকায়৷ মোদী সরকার কিনেছে ১৬০০ কোটি টাকায়৷ ইউপিএ-র চুক্তির খসড়ায় ভারতীয় বায়ুসেনার প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ১২৬টি রাফাল কেনার কথা ছিল৷ মোদী কিনেছেন মাত্র ৩৬টি৷ তা-‌ও ফ্রান্সের দাঁসো কোম্পানি সেগুলি দেবে ২০২০ সালে৷ সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হলো, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘‌হিন্দুস্থান অ্যারোনেটিক্স লিমিটেড’-‌কে এই চুক্তি থেকে বাদ দিয়ে যুদ্ধবিমান তৈরির বরাত পাইয়ে দেওয়া হয়েছে ‘‌রিলায়েন্স ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’-‌এর অনিল আম্বানিকে৷ ৩০ হাজার কোটি টাকার চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ‘‌জীবনভর চুক্তি’ হিসেবে আরো এক লক্ষ কোটির একটি চুক্তি পেয়েছে রিলায়েন্স, যা সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক৷ এছাড়া এই চুক্তি করার ক্ষেত্রে ‘‌ডিফেন্স প্রকিওরমেন্ট রুল’ মানা হয়নি৷ এমনকি আশচর্যের বিষয় হলো, অনিল আম্বানি এই বরাত পাওয়ার মাত্র ১২দিন আগেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি তৈরি করেছেন৷

এই নিয়ে যখন গোটা ভারত উত্তাল, তখন আচমকা সামনে এসেছে ফ্রান্সের তৎকালীন (‌রাফাল চুক্তির সময়)‌ প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওলদের এক বয়ান৷ ফরাসি এক ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রাফাল যুদ্ধ বিমানের চুক্তিতে ফ্রান্স কোনো বেসরকারি সংস্থা (‌রিলায়েনস) ‌পছন্দ করেনি৷ ভারত সরকারই সুপারিশ করেছিল৷ স্বভাবতই এই বিবৃতির পর ভারতে রাজনীতির বিশ্লেষকরা নরেন্দ্র মোদী সরকারকে কার্যত কোণঠাসা করতে উদ্যত হয়েছেন৷

ময়দানে সবার আগে নেমেছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস৷ তাদের সভাপতি রাহুল গান্ধী রাফাল ছাড়া আর কিছুই যেন দেখছেন না৷ সংসদে ভাষণ হোক বা প্রকাশ্য জনসভা, রাফাল দুর্নীতির অভিযোগে সরব তিনি৷ শুধু তাই নয়, প্রতিদিন নিত্যনতুন তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি চাইছেন৷ আরো চাপ বাড়িয়ে রাফাল চুক্তির তদন্তে সংসদের দুই কক্ষ লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে ‘‌যৌথ সংসদীয় কমিটি'‌ গঠনের দাবি তুলেছেন তিনি৷ ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারকে এ যাত্রায় ব্যাকফুটে যেতে দেখা যাচ্ছে৷ জেপিসি-‌র দাবিতে কিছুতেই রাজি নয় তারা৷ কংগ্রেস অবশ্য জেপিসি’র দাতি আঁকড়ে পড়ে নেই৷ ইতিমধ্যে তারা দেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল এবং চিফ ভিজিলেন্স কমিশন,‌ এই দুই স্বতন্ত্র সংস্থার কাছে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে তদন্তের আর্জি জানিয়েছে৷

ওলদের বিবৃতি প্রকাশ্যে আসার পর মোদী সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, দাঁসো ও রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেডের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে অনিল আম্বানির কোম্পানিকে বরাত দেওয়ায় ভারত সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না৷ এটা নিতান্তই দুটি সংস্থার সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি৷

মোদীর রাফাল চুক্তিতে ৩৬টি যুদ্ধবিমান কেনা হবে৷ ৯০টি বিমান তৈরি হবে ভারতে৷ সেগুলি তৈরি করবে আম্বানির কোম্পানি৷ প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি হ্যাল-‌কে বাদ দিয়ে আম্বানির ভুঁইফোঁড় সংস্থা রিলায়েন্স ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজকে কেন?‌ মোট চুক্তি ৫৯ হাজার কোটি টাকার৷ রিলায়েন্স আজীবন সুবিধা পাবে আরো এক লক্ষ কোটি টাকার৷

‌রাজীব গান্ধীর সময় দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে তো কেউ সরব হয়নি: ‌সোমেন মিত্র

ডয়চে ভেলেকে ‌পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র জানিয়েছেন, ‌‘‘‌রাজীব গান্ধীর আমলে বোফর্সে ৬৪ কোটি টাকার অভিযোগ উঠেছিল৷তিনি একদিনও দেরি না করে সংসদীয় যৌথ কমিটি গঠন করে দিয়েছিলন৷ তা সত্ত্বেও বিরোধীদের প্রচারের ভূত তার পিছু ছাড়েনি৷ তাঁকে ‘‌চোর'‌ প্রতিপন্ন করার সবরকম চেষ্টা হয়েছে৷ পরবর্তীকালে কার্গিল যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী স্বীকার করে নিয়েছে, বোফর্স না থাকলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ আরো কঠিন হতো৷ এত কিছুর পরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল যখন বলল, তারা রাফাল তৈরি করতে পারবে, তাদের বরাত না দিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থাকে চুক্তি দেওয়া হলো কেন?‌ ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট‌ ওলদ নিজেও রাহুলের বক্তব্যের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন৷ ফলে, চৌকিদারই যে ভাগীদার তা প্রমাণিত৷’’

‌মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ ও আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের বক্তব্য, রাহুল বা কংগ্রেস যে দাবি করছেন তা অমূলক৷ তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে রাফালের দাম প্রকাশ করা যাবে না৷ এই প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বললেন, ‘‌‘‌রাজীব গান্ধীর সময় দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে তো কেউ সরব হয়নি৷ ‌সেদিন দেশের নিরাপাত্তার বিষয়টা ছিল না?‌ রাজীব গান্ধীর সময়ে যদি নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, তাহলে এখনো সমস্যা হবে না৷ আর তাছাড়া সংসদীয় কমিটিতে তো বাইরের কেউ নেই, আছেন জনপ্রতিনিধি বা নির্বাচিত সাংসদরা৷ তাতে সরকার পক্ষের সাংসদরাই বেশি থাকুন না৷’’

কেন্দ্রীয় সরকার ও তাদের মন্ত্রীদের দাবি, রাজনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষমতা না থাকায় ভুয়া অভিযোগ তুলে রাজনীতির হাওয়া গরম করতে চাইছে কংগ্রেস৷ তাদের বক্তব্য, নির্দিষ্ট অভিযোগ হাতে না নিয়ে শোরগোল করা হচ্ছে৷ নিছক মনগড়া অনুমান থেকে নরেন্দ্র মোদীকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হচ্ছে৷ তবে বিজেপি এর যোগ্য জবাব দিতে তৈরি হচ্ছে৷ অন্যদিকে রাফাল নিয়ে কংগ্রেসের আক্রমণের জবাবে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর জামাই রবার্ট ভদ্রার নাম টেনে এনেছে বিজেপি৷ সাংবাদিক বৈঠকে বিজেপি নেতা গজেন্দ্র সিং শেখাবত বলেছেন, রাফাল চুক্তিতে রবার্ট ভদ্রা ও সঞ্জয় ভান্ডারির কোম্পানিকে লাভবান করতে চেয়েছিল ইউপিএ সরকার৷ তবে তা সম্ভব হয়নি৷ সেই আক্রোশে এখন রাফাল চুক্তি বাতিল করতে চাইছে তারা৷

রাফাল নিয়ে ডয়চে ভেলে কথা বলেছে বিজেপি সাংসদ রূপা গাঙ্গুলীর সঙ্গে৷

সেনাবাহিনীর অস্ত্র, সরঞ্জাম নিয়ে সবকিছু খোলাখুলি আলোচনা করা যায় না: রূপা গাঙ্গুলী

তাঁর কথায়, ‘‌‘‌রাহুল গান্ধী কোনো কেলেঙ্কারির জবাব দিতে চাইছেন, সেইভাবে দেখছি না৷ ওঁরা আসলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন৷ কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করেওছেন৷ তবে, যাঁরা এমন প্রচার করছেন তাঁরা ভালোই জানেন যে, সেনাবাহিনীর অস্ত্র, সরঞ্জাম নিয়ে সবকিছু খোলাখুলি আলোচনা করা যায় না৷ রাজ্যসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ একবার বলার চেষ্টা করেছিলেন৷ তখন কংগ্রেসে সাংসদরাই প্রতিবাদ করেছিলেন৷’’

কিন্তু রাফালের দাম প্রকাশ করতে অসুবিধা কোথায়?‌ এই প্রশ্নের জবাবে রূপার জবাব, ‘‌‘‌দাম নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে৷ জনতার সামনে তথ্য পড়ে আছে৷ সরকার বিবৃতি দিয়েছে৷ সরকার বলেছে, কোথাও অতিরিক্ত দাম দেওয়া হয়নি৷ ১০ বছর আগের চুক্তিতে কী কী ছিল, এই চুক্তিতে কী আছে, তা সরকার বলার চেষ্টা করেছে৷ বিষয়টা শুধুই রাজনৈতিক বলে মনে হয়৷ কিন্তু, কোন বিষয় নিয়ে রাজনীতী করবেন, কোন বিষয় নিয়ে করবেন না, সেটা ওঁদের ঠিক করে নেওয়া উচিত৷’’

এখন দেখার রাফালের জল কতদূর গড়ায়৷‌ আগামী লোকসভা নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে এই বিতর্ক৷