পূর্ব কলকাতা জলাভূমি এখন বেআইনি কাজের আঁতুড়ঘর
ধীরে ধীরে ভরাট হচ্ছে কলকাতার একমাত্র জলাভূমি অঞ্চল ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড। কী করছে পুরসভা?
গুলশান কলোনি
কিছু বছর আগেও পূর্ব কলকাতার পশ্চিম চৌবাগা অঞ্চল ফাঁকা ছিল। বিঘার পর বিঘা জলজমি। গুলশান কলোনির নাম তখনও কেউ জানত না। এরপর সেখানকার প্রায় ২৫০ বিঘে ভেড়ি–জলাশয় বেআইনি ভাবে বুজিয়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ। এখন সেই গুলশান কলোনিতে চলছে বেআইনি কারখানা এবং গড়ে উঠছে বহুতল।
দুষ্কৃতীদের মরুদ্যান
এ যেন দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল! পুলিশি তল্লাশিতে কখনও উদ্ধার হচ্ছে বোমা, কখনও প্রোমোটিং সংক্রান্ত বিবাদের জেরে চলছে গুলি। আবার কখনও ভিন্ রাজ্যের পুলিশের হানায় গ্রেফতার হচ্ছে একের পর এক অনুপ্রবেশকারী। অপরাধ যেন পিছু ছাড়ে না গুলশন কলোনির।
খবরের শিরোনামে
ইএম বাইপাসে সায়েন্সসিটি থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই গুলশান কলোনি কখনও অনুপ্রবেশকারীদের জন্য, আবার কখনও দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্তের জেরে শিরোনামে উঠে এসেছে। কলকাতা পুরসভার ১২ নম্বর বরোর চেয়ারপার্সন তথা কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে খুনের চেষ্টার ঘটনায় গুলশান কলোনি আবার আলোচনায়।
সুশান্ত ঘোষকে মারার চেষ্টা
গত ১৫ নভেম্বর গুলি করে খুন করার চেষ্টা হয় কলকাতা পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি সুশান্ত ঘোষকে। স্কুটারে করে কসবায় এসে তার বাড়ির সামনেই পিস্তল নিয়ে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। শেষ মুহূর্তে গুলি না চলায় রক্ষা পান সুশান্ত। সেই ঘটনার তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই চার জনকে গ্রেফতার করেছে লালবাজার। তাদের মধ্যে একজন এই গুলশান কলোনির।
জমি-বাড়ির চক্র
জমি-বাড়িকে কেন্দ্র করে একাধিক গোষ্ঠীর বিবাদের জেরে উত্তেজনা ছড়ানো গুলশন কলোনিতে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সম্প্রতি পুরপ্রতিনিধিকে খুনের চেষ্টার ঘটনার পর উত্তেজনার আঁচ চরমে। এলাকা দখলে রাখার পাশাপাশি, বিরোধী গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করার লড়াই, গুলশন কলোনি এখন দুষ্কৃতীদের মুক্তাচল বলে মনে করছেন অনেকে।
প্রোমোটিং রাজ
কারণ হিসেবে এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ কখনও দায়ী করছেন প্রোমোটিং-রাজকে, কেউ আবার এলাকা দখল এবং রাজনৈতিক দলের একাংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতের কথা তুলে ধরছেন। তাদের আরও অভিযোগ, পুলিশ সবটা জানা সত্ত্বেও পরিস্থিতির বদল হয় না! উল্লেখ্য, ওই এলাকায় দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে না প্রশাসন। পুলিশের দাবি, “নজরদারি চালানো হয় নিয়মিত।’’
যৌথ অভিযান
২০২১ সালে এই গুলশান কলোনি থেকেই যৌথ অভিযান চালিয়ে ১৭ জন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেপ্তার করেছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের জঙ্গি দমন শাখা এবং কলকাতা পুলিশ। পুলিশের নজর এড়িয়ে এই এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে ধৃতেরা নানা বেআইনি কাজ চালাতো বলে তাদের জেরা করে জানা গিয়েছিল।
তাজা বোমা উদ্ধার
তার আগের বছরের জানুয়ারিতে এই গুলশন কলোনিরই একটি নির্মীয়মাণ বাড়ি থেকে অভিযান চালিয়ে ১৬টি তাজা বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। সঙ্গে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির মশলা। তার দিনকয়েক পরেই প্রোমোটিং সংক্রান্ত বিবাদের জেরে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে সেখানে।
উত্তরপ্রদেশ-বিহারের লোক
কলকাতা পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে গুলশান কলোনি। ভোটারের সংখ্যা কমবেশি ১৫০০। তবে ওই এলাকায় প্রায় এক লাখের কাছাকাছি মানুষ বসবাস করেন বলে খবর, যাদের অধিকাংশই উত্তরপ্রদেশ, বিহারের লোক।
সহজেই মেলে পরিচয়পত্র
ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদের এখানে সরকারি পরিচয়পত্র পেতে খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না। ভুয়ো পরিচয়পত্র সহজে মিলে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশের থেকেও নাগরিকরা আসছেন বলে মনে করছেন অনেকে। ফলত, লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে আস্তানার চাহিদা। আর তা মেটাতে গিয়েই লড়াই হচ্ছে সিন্ডিকেটের।
জলাভূমি বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণ
এলাকার এক বাসিন্দা জানালেন, জলাভূমি বুজিয়ে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেআইনি উপায়ে বাড়ি তৈরি হচ্ছে বলেই বাইপাস সংলগ্ন এমন ‘প্রাইম লোকেশানে’ সস্তায় ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছে।
রাজনীতির ছত্রছায়া
অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এই এলাকার একটি বড় অংশকে বরাবরই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, গত কয়েক বছরে আশপাশের এলাকায় বেআইনি নির্মাণ হলেও ওই এলাকার তেমন কোনও উন্নয়ন হয়নি। অথচ, দখল হয়েছে একের পর এক সরকারি জমি! যাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে প্রোমোটিং-চক্র।
এলাকায় 'দাদা-রাজ'
কিন্তু কেন এই দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্য? স্থানীয় এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘আসলে সরকারি জমির একাংশ দখল করে, বেআইনি বাড়ি বানিয়ে লোক বসিয়ে দেওয়া হয়। বিনিময়ে মোটা টাকা নেওয়া হয়। কোনও কিছুই এলাকায় এই ‘দাদাদের’ নজর এড়িয়ে করা যায় না, এবং এই দাদাদের মাথায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের হাত।”