‘পৃথিবী আমারে চায়’
১৭ নভেম্বর ২০১৪ওরা কিছুটা বাড়িয়ে বলছে৷ জার্মানি এবং আমরা জার্মানরা নাকি সারা বিশ্বে সবচেয়ে আদরের দেশ৷ এবারকার নেশন ব্র্যান্ড ইনডেক্স তাই বলছে৷ জিএফকে মার্কেটিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট বিশটি দেশের বিশ হাজারের মানুষের অনলাইন জরিপ করে এই তথ্য বার করেছে৷ তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল: জার্মানি৷ ভালোই তো৷ পৃথিবী আমারে চায়৷
আজ যে সব জার্মানদের বয়স ৫০ থেকে ৫৫'র মধ্যে, তাদের কাছে এটা কল্পনা করা সহজ নয় – কেননা এই মাঝের প্রজন্মটি বেশ কিছু আত্মগ্লানি নিয়ে বড় হয়েছে৷ আমাদের পিতৃ-পিতামহের প্রজন্মের অপকর্মের বোঝা ছিল আমাদের উপর, যে কারণে আমরা নিজেদের সহ্য করতে পারতাম না৷ যে কারণে আমরা স্বদেশপ্রেমী ফরাসি আর স্বাধীনচেতা ব্রিটিশদের পছন্দ করতাম: দু'টি দেশই ছিল আমাদের কাছে ‘স্বাভাবিক' দেশ৷
আমরা নিজেরা সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলাম না: আমরা ছিলাম ভয়াবহ অতীত ও আহত সত্তা সম্বলিত একটি বিভক্ত দেশ৷ জার্মানদের গুণগত উৎকর্ষ বলতে লোক বুঝতো কর্মনিষ্ঠা, নির্ভরযোগ্যতা, সময়ানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলা৷ সে জন্য কদর পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা পাওয়া যায় না – এই ছিল আমাদের ধারণা৷ এক কথায়: আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগছিলাম৷ আজ যে আমরা অন্যের কাছে স্বপ্নের দেশ, তা থেকে বোঝা যায় দিন কতোটা এবং কী ভাবে বদলেছে৷
পালাবদলের পালা
কিন্তু এই পরিবর্তন এলো কী ভাবে? নানাভাবে, নানা পন্থায়৷ প্রথমত কালের যাত্রা, কালের প্রবাহ, যা সব কিছু ভুলিয়ে দেয়, সব কিছু বদলে দেয়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং নাৎসি আমলের জার্মানরা আজ প্রায় কেউ বেঁচে নেই৷ যে সব মানুষ তাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তারাও প্রায় সবাই বিদায় নিয়েছেন৷ আজ আর বিদেশে জার্মানদের সেই চিরন্তন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না: ‘‘সে আমলে তুমি কী করছিলে?'' যার ফলে মানুষজনের সঙ্গে আলাপচারী সহজ হয়, খোলামেলা হয়, অকুণ্ঠ হয়৷
এছাড়া জার্মানরা নিজেরাই তাদের অতীতের পর্যালোচনা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে৷ বহু প্রতীকী মুহূর্ত এসেছে এবং গেছে: ওয়ারশ-র গেটো-তে ভিলি ব্রান্ড-এর নতজানু হওয়া থেকে শুরু করে ভ্যারদঁ-র সমাধিক্ষেত্রে হেলমুট কোল এবং ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ-র হাতে হাত ধরে দাঁড়ানো৷
সুপ্রতিবেশী
সবচেয়ে বড় কথা: জার্মানি আজ ৬৫ বছর ধরে সুপ্রতিবেশী৷ ৪০ বছর ধরে দেশবিভাগ, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ পেরিয়ে বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ অবধি জার্মানি কখনো অপরের বিরোধিতা করে তার নিজের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করেনি৷ ইউরোপ-কে সঙ্গে রেখেই জার্মানি এগোতে পারে, ইউরোপ-কে বাদ দিয়ে নয়৷
এ সবের ফলে জার্মানরা নিজেরাই আরো সহজ হয়েছে, আগের মতো অতোটা আড়ষ্ট নেই৷ ২০০৬ সালে জার্মানিতে আয়োজিত বিশ্বকাপেই সেটা পরিলক্ষণ করা গিয়েছিল – তার পরে আবার বার্লিন প্রাচীর পতনের ২৫তম বার্ষিকীতে৷ জার্মানরা আজ নিজেদের নিয়ে আনন্দ করতে পারেন, অন্যদের শঙ্কার কারণ না ঘটিয়ে৷
বহির্বিশ্বের প্রত্যাশা
জার্মানরা যে এবার আত্মম্ভরি হয়ে উঠবেন, এ আশঙ্কা করারও কোনো কারণ নেই৷ বরং তার উলটোটাই ঘটবে: তার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে যে জার্মানির দায়িত্ব বেড়েই চলেছে, তাতে জার্মানরা সত্যিই কিছুটা শঙ্কিত৷ রাজনীতিকদের ভয়, তারা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিলেই আবার ‘‘বিভীষণ জার্মান''-এর কথা উঠে পড়বে৷ আজও বিদেশি পত্রিকার ব্যঙ্গচিত্রে জার্মান রাজনীতিকদের নাৎসি উর্দি পরিহিত অবস্থায় দেখানো হয়৷
পোল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোসুয়াভ সিকর্স্কি একবার বলেছিলেন: ‘‘আজ আমি জার্মানির ক্ষমতাকে যতোটা না ভয় পাই, তার চেয়ে বেশি ভয় পাই জার্মানির নিষ্ক্রিয়তাকে৷'' এ কথা বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন পোলিশ বুদ্ধিজীবী৷ জার্মানির পক্ষে এর চাইতে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে?