1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পেশাজীবীদের বেপরোয়া সিন্ডিকেট

২০ মে ২০১৯

নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের সব পেশাজীবীদেরই সংগঠন আছে৷ এসব সংগঠন দলীয় পরিচয়েও করা হয়৷ প্রশ্ন হলো, তা কতটা তাদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে আর কতটা অবৈধ স্বার্থ আদায়ে সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করে?

https://p.dw.com/p/3IhuX
ফাইল ফটোছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচ জনের নিহতের ঘটনায় বাসচালক জামিরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বাতিলের দাবিতে সারাদেশে পরিবহণ ধর্মঘট৷ যানবাহন চলাচল বন্ধ৷ ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ৷

১৮ জুন, ২০১৭

বিভিন্ন সময় হামলা ও নিরাপদ কর্মস্থলের দাবিতে সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসক ধর্মঘট৷ ব্যক্তিগত রোগী দেখা বন্ধ রাখে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন৷ রেগীরা চরম বিপাকে৷

১১ ফেবুয়ারি, ২০১৯

দুই বছর আগে অবসর নেওয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ও সিবিএ নেতা আলাউদ্দীন মিয়ার কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের একটি পাজেরো গাড়ি উদ্ধার করে দুদক৷ ২০০৯ সাল থেকে গত ১০ বছরে গাড়িটির জন্য পিডিবি থেকে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ডিজেল খরচ তুলেছেন তিনি৷ 

‘‘নেতারা রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আখের গোছানোর কাজ করেন’’

সম্প্রতি নড়াইলের এমপি এবং জাতীয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মোর্তজার নড়াইল সদর হাসপাতাল পরিদর্শনের বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড় ওঠে৷ হাসপাতালে গিয়ে তিনি বেশির ভাগ চিকিৎসককেই পাননি৷ রোগী সেজে কথাও বলেন একজন চিকিৎসকের সঙ্গে৷ অস্ত্রোপচারের জন্য পরে আসতে বলায় বিরক্তি এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক৷ এ ঘটনায় ওই হাসপাতালে অনুপস্থিত চিকিৎসকরা সামায়িক বরখাস্তও হন৷ কিন্তু বিষয়টি সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না৷ চিকিৎসকদের একাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাশরাফির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নামেন৷ একজন তো রীতিমতো মাশরাফিকে অশ্লীল গালাগালও করেন৷ পরে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ চিকিৎসদের একাংশ মনে করেন, মাশরাফি ফোনে অনুপস্থিত চিকিৎসককে ‘‘আপনাকে কী করতে পারি'' বলে হুমকি দিয়েছেন৷ চিকিৎসকদের অনেকে বলেন, সাংসদের কিছু করার ক্ষমতা নেই৷ তবে এবার চিকিৎসকরা আন্দোলনে নামেননি৷ তবে অতীতে চিকিৎসকদেরও হাসপতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দাবি আদায়ের অনেক নজির আছে৷

এটা যে শুধু চিকিৎসকরাই করেন, তা কিন্তু নয়৷ সব পেশার লোকজনেরই এখন পেশাজীবী সংগঠন আছে৷ তাঁরা তাঁদের দাবি আদায়ে মাঠে নেমে পড়েন৷ সেই দাবি ন্যায্য হোক আর অন্যায্য হোক, তাঁরা মাঠে নামতে পারেন কিনা, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে পারেন কিনা অথবা রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দিতে পারেন কিনা, এসব বিবেচনা তাঁরা করেন না৷ 

আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘এটা এখন সিন্ডিকেটের মতো হয়ে গেছে৷ পেশার উন্নয়নে কাজ না করে, পেশাগত ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার জন্য কাজ না করে তারা অনেক সময়ই অবৈধ সুবিধা নিতে চায়৷ আর নেতারা রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আখের গোছানোর কাজ করেন৷''

বাংলাদেশে শ্রমিকরা শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন৷ তা কিভাবে করতে হয় এ সম্পর্কে আইনি বিধান আছে৷ শ্রমিকদের যৌথ দর কষাকষির জন্য সিবিএ খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এর বাইরে প্রশাসনের কর্মকর্তা, চতুর্থ বা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, শিক্ষক, পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ এমন কোনো পেশা নেই, যাদের পেশাজীবী সংগঠন নেই৷ শুধু তাই নয়, দলীয় ব্যানারেও আলাদা সংগঠন আছে৷  সাবেক বিচারক এবং সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিষ্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেন, ‘‘শ্রমিকদের সংগঠন করার ক্ষেত্রে শ্রম আইন মেনে চলতে হবে৷ আর পেশাজীবীদেও যে কোড অব কন্ডাক্ট আছে, তা মেনে চলতে হবে৷ এসব সংগঠন খখনোই সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে পারে না৷ রোগীদের জিম্মি করতে পারেনা৷ যাত্রীদের জিম্মি করতে পারে না৷ নাগরিকদের তাঁর প্রাপ্য সেবা বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তারা পারবে না৷ মানুষের স্বাধীন চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না৷''

বাংলাদেশের সরকারি ব্যংকগুলোতে সিবিএ নেতাদের দাপট৷ তাদের বদলি করা যায় না৷ আর ব্যাংকের মধ্যেই মাইক লাগিয়ে তারা সভা-সমাবেশ করেন৷ সেখানে মন্ত্রীদেরও উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পর্যন্ত অতীতে সিবিএ নেতার হুমকি দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে৷ এসব নেতারা অবসরে গিয়েও ব্যাংকের গাড়িসহ নানা সুবিধা ভোগ করেন৷ সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ বিভাগ ও ডেসা এবং ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠানও সিবিএ নেতাদের হাতে জিম্মি৷ নেতারা কোটি কোটি টাকার মালিক এমন খবর গত কয়েক দশক ধরে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে৷

বাংলাদেশের সরকারি পাটকলের বর্তমান দুরবস্থার জন্য শ্রমিক নেতাদেরই দায়ী করা হয়ে থাকে৷ মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘এই সিবিএগুলো রাজনৈতিভাবে ক্ষমতাবান৷ এরা কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসেবে তাদের ছত্রছায়ায় কাজ করে৷ ফলে তাদের মূল কাজ শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ (করা হলেও তারা) তা করে না৷ তারা নানা অবৈধ এবং অনৈতিক সুবিধা নেয়৷''

বাংলাদেশে পরিবহণ শ্রমিকদের সংগঠনগুলো একেকটি শক্ত সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে৷ তারা চাইলে অল্প সময়ের মধ্যেই সারাদেশের যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারে৷ বারবার তারা এটা করেছেও৷ বিশেষ করে কোনো শ্রমিক বা চালক দুর্ঘটনার কারণে গ্রেপ্তার হলে বা সড়ক-শৃঙ্খলায় কঠোর কোনো আইন করতে গেলেই তারা যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়৷ আবার পরিবহণ শ্রমিকদের শীর্ষ নেতা হওয়ার পর শাজাহান খান মন্ত্রীও ছিলেন৷ মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘কে কত লোক রাস্তায় নামাতে পারে বা কার লোকবল কত বেশি তার ওপর নির্ভর করে সিন্ডিকেটের শক্তি৷ পরিবহণ শ্রমিক সংখ্যায় বেশি৷ আর যোগাযোগের সড়ক, যানবাহণ যেহেতু তাদের নিয়ন্ত্রণে, তাই তারা যা খুশি তা-ই করতে পারে৷ তাদের নেতা একই সাথে মন্ত্রী থাকায় সরকারে বসেও তিনি তাদের পক্ষে কাজ করতে পারেন৷ তার রাজনৈতিক ক্ষমতাও আছে৷'' 

‘‘তারা অশুভ সিন্ডিকেট’’

তিনি বলেন, ‘‘চিকিসকদের অবস্থাও তাই৷ তাদের হাতে সারা দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থা৷ তারা সেবা দেয়া বন্ধ করে দিলে সাধারণ মানুষের কোনো উপায় থাকে না৷ তাঁরা জিম্মি হয়ে পড়েন৷ কিন্তু চিকিৎসকরা আইন বা পেশাগত নীতিকে তোয়াক্কা না করে সংখ্যার জোরে, ক্ষমতার জোরে মানুষকে জিম্মি করে৷''

তাদের ক্ষমতার উৎস কি শুধু তাদের সংখ্যা আর পেশাগত নির্ভরতা? টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘তাদের মূল ক্ষমতা রাজনীতি৷ তারা পেশাজীবী নেতা হয়ে, শ্রমিক নেতা হয়ে সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত৷ তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আছে৷ এই সংগঠনগুলোর যখন নির্বাচন হয়, তখনো আমরা দেখি সেখানে রাজনৈতিকভাবে প্রার্থী ঠিক হয়৷''

তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতির কারণে তারা ক্ষমতার সঙ্গেও যুক্ত৷ তাই দেখা যায়, যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানে সিবিএ আছে, তার নেতারা সেখানকার নিয়োগ, বদলিসহ নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত৷ তারা অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে এর মাধ্যমে অর্থ আয় করে৷''

আর রাজনৈতিত প্রভাবের কারনেই বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানেও তাদের দৌরাত্ম৷ দৌরাত্ম সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে৷ তাদের বদলি করলেও তা আবার প্রত্যাহার করতে হয়৷ ২০১৭ সালে রূপালী ব্যাকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে মারধর করেন সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক৷ তাদের বরখাস্ত করা হলে পুনর্বহাল করার হুমকি দেন তখনকার নৌমন্ত্রী এবং শ্রমিক নেতা শাজাহান খান৷ 

‘‘তাদের মূল ক্ষমতা রাজনীতি’’

মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘সিবিএ এবং পেশাজীবী সংগঠনগুলো তাদের মূল উদ্দেশ্যের বাইরে চলে গেছে৷ তাই তাদের আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা প্রয়োজন৷ পেশাজীবীদের এই সিন্ডিকেট দৌরাত্মের বাইরে আইনজীবী এবং সাংবাদিকরাও নন৷ অনেক সাংবাদিক নেতা আছেন, যাদের নেতাগিরি আছে, সাংবাদিকতা নেই৷ তারা সংগঠন করেই তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করেন৷ তারা রাজনীতি এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত৷''

ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, ‘‘এদের রাজনীতির বাইরে আনতে হবে৷ রাজনীতির কারণে এই ধরনের সংগঠন দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে৷ সরকারের এটা দেখা প্রয়োজন৷''

আর ইকতেদার আহমেদ বলেন, ‘‘যারা আইন অমান্য করে, আইনের বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, তারা পেশাজীবী সংগঠন হতে পারে না৷ তারা অশুভ সিন্ডিকেট৷''

এই ধরনের সংগঠন সরকার ও রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর বলে তারা মনে করেন৷ কারণ, তারা জনগণকে জিম্মি করলে সরকার যখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না, তখন সরকারের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ৷''

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য