দয়া করে মন্ত্রীদের ভাতিজাদের সামলান
১৩ আগস্ট ২০১৫সমালোচনায় কান না দেয়া দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ সমালোচক মানেই যেন শত্রু৷ তাই বিরোধী বা সরকারের বাইরের কারো কথা না-ই বা বলি৷ আজ বরং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি মন্তব্য শুরুতেই আপনাকে মনে করিয়ে দিই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী৷ কয়েকদিন আগেই ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাস্তা দখলমুক্ত করতে না পারলে বাংলাদেশ থেকে কোনোদিনই যানজট দূর করা যাবে না৷
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী পরিষ্কার ভাষায় বুঝিয়ে দেন, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কোনোভাবে নিজেকে জড়িয়ে কিছু মানুষ কীভাবে আখের গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে৷ ওবায়দুল কাদের নাকি আজকাল কোনো অনুষ্ঠানে গেলে পেছনে কাউকে দাঁড়াতেই দেন না৷ কারণ তিনি দেখেছেন, যারা সুযোগ পেলেই তাঁর পেছনে এসে দাঁড়ায়, তারা সেই অবস্থায় কিছু ছবি তুলে নেয় এবং পরে সেই ছবি দেখিয়ে বলে ‘আমি মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা'৷ অথচ একটা ছবি তুলেই যারা এভাবে নানা ধরণের ফায়দা তোলার চেষ্টা করে, তারা মন্ত্রীর ‘চৌদ্দ পুরুষেরও কেউ না'৷ মন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘‘মন্ত্রী হলে বন্ধু, ভাস্তে, ভাতিজার অভাব হয় না৷ কিন্তু ক্ষমতায় না থাকলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না৷''
মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঠিকই বলেছেন৷ তবে যারা সত্যিই কোনো মন্ত্রীর ভাই, ভাতিজা, মামা, ভাগ্নে বা বন্ধু, তাদের ছবি তোলার প্রয়োজন হয় না৷ চাইলেই মন্ত্রীর সঙ্গে সামান্য আত্মীয়তার পরিচয় ভাঙিয়েও রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায়৷ এমন পরিচয়ের সুবিধা নিয়ে নানা ধরণের অপকর্মেও জড়ায় অনেকে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজ এমন একটি খবরেই আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷
একটি জাতীয় দৈনিকের খবর অনুযায়ী, ব্লগার নিলয় হত্যায় জড়িত সন্দেহে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)-এর কয়েকজন সদস্যকে নজরদারির আওতায় এনেছে গোয়েন্দা সংস্থা৷ সন্দেহভাজন হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা সাদ আল-নাহিনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷
সাদ আল-নাহিনের নাম আগেও সংবাদমাধ্যমে এসেছে৷ ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন হত্যাচেষ্টার মামলায় যে ১০ জনের বিরুদ্ধে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছিল, সেখানে তার নামও ছিল৷ অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, আসিফের ওপর হামলায় শুধু অংশ নেননি, নেতৃত্বও দিয়েছিলেন নাহিন৷ একটু আগেই টেলিফোনে এ বিষয়ে আসিফ মহিউদ্দীনের সঙ্গে কথা হলো৷ আসিফ জানিয়েছেন, তাঁর ওপর হামলার অভিযোগে নাহিন যখন কারাগারে, তখন তাঁকেও কারাবরণ করতে হয়েছিল৷ সেই সূত্রে হামলাকারী এবং হামলার শিকারের দেখা হয়ে যায়৷ সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা কেমন তা জানতে চাওয়ায় আসিফ মহিউদ্দীন বললেন, ‘‘আমার ওপর পেছন থেকে হামলা চালানো হয়েছিল৷ তাই আমি হামলাকারীদের দেখিনি এবং অভিযোগপত্রে কারো নাম উল্লেখও করিনি৷ কিন্তু কারাগারে আমাকে দেখেই নাহিন সরাসরি বলেছিল – ‘একবার বের হই, দেখে নেবো'৷''
নাহিন ঠিকই জামিনে বের হয়েছেন৷ জাতীয় দৈনিকের খবর অনুযায়ী, ব্লগার নিলয় নিহত হওয়ার পর আবার আটকও হয়েছেন৷
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজকাল ব্লগার হত্যার পরই জঙ্গি সংগঠন দায় স্বীকার করছে৷ পুলিশও বলছে, জঙ্গিরাই দায়ী৷ আবার এ-ও বলছে, জঙ্গি নাকি নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু তাদের নির্মূল করা সম্ভব নয়৷ কী আজব কথা! পুলিশ কেন বলছে এমন কথা? নির্মূল তো দূরের কথা, জঙ্গি কিংবা জঙ্গিদের প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই কী কী কারণে এমন কথা বলা হতে পারে – এতদিন সে হিসেব মেলানোর চেষ্টা চলছিল৷ অনেকে অনেক কথাই বলেছেন, বলছেন৷ অনেক লেখালেখিও হয়েছে এবং হচ্ছে৷ কোনোকিছুই বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয় না৷ তবে নাহিন আবার আটক হয়ে থাকলে কারো বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, মন্ত্রীর ভাতিজাও যদি জড়িত থাকে তাহলে জঙ্গিবাদ নির্মূল তো হবেই না, বরং তা আরো ছড়িয়ে পড়বে৷
এই ‘ভাতিজাদের' দৌরাত্ম নানাভাবে দেখেছি আমরা৷ সরকারি কাজে বাধা দিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের ভাতিজাকে গ্রেপ্তার হতে দেখেছি৷ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ভাতিজা সাংবাদিক পিটিয়েছেন৷ আমরা অবাক হয়ে শুনেছি, স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রী বলছেন, ‘‘আমার অনেক দুষ্টু আত্মীয় আছে৷'' স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মন্ত্রীত্ব গেছে, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ‘ভাতিজারা' এখনো আছে৷ আছে বলেই, ব্লগারের ওপর হত্যা প্রচেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে আমরা আবার ব্লগার হত্যায় জড়িত সন্দেহে আটকের খবর পড়ি৷
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই ভাতিজা ও ভাতিজাদের চাচাদের সামলান এবং জঙ্গিদের হাত থেকে ব্লগার এবং দেশটাকে বাঁচান৷