1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রশাসনে নারী: ধীরে ভাঙছে ট্যাবু

২৫ জুন ২০২১

বাংলাদেশের প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিতে নারীদের অবস্থান সংহত হচ্ছে। নারীরা তৃণমূলে যেমন কাজ করছেন, তেমনি রয়েছেন শীর্ষ পদে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়- নারীরা কতটুকু সুযোগ পাচ্ছেন?

https://p.dw.com/p/3vZmk
ছবি: Samir Kumar Dey/DW

বাংলাদেশে এখন ১৪৯টি উপজেলায় নির্বাহী অফিসার পদে কর্মরত আছেন নারী। আর উপজেলা হলো বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সরকারের  যেকেনো ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় এই পর্যায় থেকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সরাসরি সাধারণ মানুষের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করতে হয়। তাদের সামাল দিতে হয় স্থানীয় নানা সমস্যা থেকে শুরু করে উন্নয়নমূলক কাজ। এই করোনার সময় লকডাউন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা থেকে শুরু করে উপজেলার প্রধান নির্বাহী হিসেবে তাদের সবকিছুই দেখতে হয়।  ঢাকার কাছেই রুপগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুশরাত জাহান। তিনি বললেন, ‘‘গভীর রাতে আগুন লাগলে আমাকে ছুটে যেতে হয়৷ করোনার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিতেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয়। আবার উন্নয়নমূলক সভাও করতে হয়। আমি নারী নয়, মানুষ হিসেবেই এই দায়িত্ব পালন করি। আর এটা করতে গিয়ে এখন আর সমস্যা হয় না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি আমার কাজের জন্য সব ধরনের নিরাপত্তারও ব্যবস্থা আছে।”

বাংলাদেশে উপজেলা ৪৬০টি। আর সেই বিবেচনায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে নারীরা আছেন চার ভাগের এক ভাগ। কিন্তু মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী।

বর্তমানে জেলা প্রশাসক পদে আছেন ১০জন নারী। আর সচিব বা সমমর্যাদার পদে আছেন ১০ জন নারী। সচিবরা বাংলাদশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছেন। সংখ্যার দিক দিয়ে দেখলে অনেক মনে হলেও আনুপাতিক হারে কিন্তু এই সংখ্যা বেশি নয়। জেলা প্রশাসক পদে ২০ ভাগের কম। সচিব পদেও তা একই রকম।

শায়লা ফারজানা

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব শায়লা ফারজানা বলেন, ‘‘নারীরা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সেটা আনুপাতিক হারে কত? নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন সত্য। কিন্তু আরো বহু পথ বাকি।’’

প্রশাসনের ওই উচ্চ পর্যায়ে যেতে বা পদোন্নতি পেতে সবার মতো নারীকেও এএসবি পার হতে হয়। কিন্তু এসএসবিতে এখনো নারীর অবস্থান নেই। শায়লা ফারজানা বলেন, ‘‘সন্তুষ্টির জায়গা হলো আগে ছিলো না, এখন আছে। আগে কম ছিল, এখন বাড়ছে। তবে ফেসবুক না থাকলে বুঝতে পারতাম না নারী সম্পর্কে এখনো যে সমাজের, বিশেষ করে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কোন পর্যায়ে রয়েছে। একই পদে কাজ করে একজন নারী যদি কোনো ভুল করেন, তাহলে তাকে নিয়ে পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি সমালোচনা হয়, কথা হয়।’’

শাহ নুশরাত জাহান বলেন, ‘‘আমি হয়ত ঢাকার কাছে রূপগঞ্জের ইউএনও। এখানে লোকজন শিক্ষিত বেশি। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব নারী ইউএনও কাজ করেন, তাদের নানা ধরনের স্থানীয় সমস্যার মেকাবিলা করতে হয়। আর এই সময়ে এসে যখন বলা হয় নারী ইউএনওরা মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেলে গার্ড অব অনার দিতে পারবেন না, তখন বাস্তব অবস্থা বুঝতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না।’’

গত মার্চের হিসাব অনুযায়ী সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৭৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারী কর্মকর্তা ১০ জন, ৫১১ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৮৩ জন, ৬৩৬ জন যুগ্ম-সচিবের মধ্যে ৮১ জন নারী কর্মকতা রয়েছেন।

আর এক হাজার ৬৯৫ জন উপসচিবের মধ্যে ৩৪৯ জন নারী, এক হাজার ৫৪৯ জন সিনিয়র সহকারি সচিবের মধ্যে ৪৫৪ জন নারী এবং এক হাজার ৫২৮ জন সহকারি সচিবের মধ্যে ৪৭২ জন নারী।

নারীরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ও ডেপুটি চিফ প্রটোকল শারমিনা নাসরিন বলেন, ‘‘এই দায়িত্বে কোনো টাইম টেবিল নাই। কখনো ভোর ৫টায় বের হতে হয়, আবার কখনো রাতে। তাই পরিবারের সমর্থন ও সহায়তা অনেক বেশি প্রয়োজন।’’ তিনি মনে করেন, নারীদের ব্যাপারে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন হচ্ছে।  তিনি আগে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জানান, ‘‘সেই সময় উন্নয়নমূলক কাজ করতে গিয়ে আমাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয়েছে। মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজ করতে গিয়ে সন্ধ্যা বা রাত হয়েছে। আমি মসজিদে পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছি। কোনো সমস্যা হয়নি। সবাই এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন।’’

বাংলাদেশের বিচার বিভাগেও নারীদের অবস্থান সংহত হচ্ছে।  সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কোনো নারী বিচারপতি না থাকলেও হাইকোর্ট বিভাগে এখন ছয় জন বিচারপতি আছেন। আর অধস্তন আদালতে নারী বিচারক রয়েছেন প্রায় চারশ'। তবে এটাও ২০ ভাগের কম। উচ্চ আদালতে ১০ ভাগের কম।

বাংলাদেশ পুলিশে মোট নারী সদস্যের সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩ জন। তাদের মধ্যে ডিআইজি দুইজন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি তিনজন, পুলিশ সুপার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১০৯ জন ও সহকারি পুলিশ সুপার ১০০ জন। ইন্সপেক্টর  ১০৯, এসআই ৭৯৭, সার্জেন্ট ৫৮, এএসআই এক হাজার ১০৯, নায়েক ২১১ এবং কনস্টেবল ১২ হাজার ৫৯৪ জন।

রোখসানা খাতুন

তবে সরাসরি জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পাঁচ জেলায় নারীরা কাজ করছেন। কাজ করছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসবে।

নড়াইলের নাড়াগাতি থানার ওসি রোখসানা খাতুন। তিনি জানান, ‘‘ওসি হিসেবে যোগ দেয়ার পর স্থানীয় অনেকেই হতাশ হয়েছিলেন। তারা বলতেন, একজন নারী ওসি কী করবেন! জাঁদরেল একজন ওসি চেয়েছিলাম, পেলাম নারী ওসি। তাদের চিন্তায় জাঁদরেল মানে পুরুষ, নারীরা জাঁদরেল হতে পারে না।  কিন্তু এখন তাদের হতাশা কেটেছে। ওসি হিসেবে যা কাজ সবই তো আমি করি। অপরাধ দমন করি। অভিযানে যাই। অপরাধীদের আটক করি। এসব করতে গিয়ে আমাকে এখনও কোনো খারাপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি।”

তবে তিনি বলেন,‘‘মুখে যা-ই বলুক অনেক পুরুষই এখনো নারীদের সম্পর্কে পুরোনো ধারণায়ই রয়ে গেছে। এটা পরিবারেও আছে। দেখা যায়, তাদের মুখের কথার সাথে চিন্তার মিল নাই।’’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। নৌ ও বিমান বাহিনীতেও তারা পিছিয়ে নেই। সেনা বহিনীতে সৈনিক থেকে শুরু করে মেজর জেনারেল পর্যায় পর্যন্ত রয়েছেন নারী। আছেন প্যারা ট্রুপার। নারীরা জাতি সংঘের শান্তি মিশনেও দায়িত্ব পালন করছেন।

নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘‘পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। উচ্চপদে যেসব নারী আছেন, তারা হয়ত তেমন প্রতিকূলতার মুখে পড়ছেন না, কিন্তু তৃণমূলে বা নিম্নপদের নারীদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে তাদের জন্য কর্মপরিবেশ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এটা খুবই জরুরি।”

তার মতে, ‘‘নারীদের যেমন সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি, তেমনি আবার কেউ কেউ আছেন নারী হওয়ার সুবিধা নিতে চান। এই দুই মাসনিকতারই পরিবর্তন দরকার।”

আর শায়লা ফারজানা মনে করেন, ‘‘নারীদের পরিবর্তন হয়েছে। তাদের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু পুরুষের উন্নতি হয়নি। তাদের উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।’’