ফের মেট্রো বিভ্রাট, কেন বারবার বিঘ্ন?
১৬ এপ্রিল ২০২৪১৯৮৪ সালে দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় কলকাতায়। গত কয়েক বছরে কলকাতার মতো শহরে মেট্রো রেল গণপরিবহনের একটা উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ হিসেবে উঠে এসেছে।
গতকাল কলকাতা মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ মার্চ মাসের যাত্রী পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু মার্চ মাসে দক্ষিণেশ্বর থেকে কবি সুভাষ রুটের মেট্রো দেড় কোটির বেশি যাত্রী পরিবহন করেছে।
কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অফিস যাত্রীরা সহ অধিকাংশ মানুষই মেট্রোর উপর নির্ভরশীল। তাই অফিস টাইমে মেট্রোর যান্ত্রিক ত্রুটি হলে যাত্রীরা চরম বিপদে পড়েন।
একদিকে মাত্রাতিরিক্ত গরম, অন্যদিকে মেট্রো বিভ্রাট। সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা পথচলতি মানুষজনের। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, মাটির নীচে মানুষের সফরের নিশ্চয়তা কতটা?
মেট্রো বিভ্রাট
মঙ্গলবার সপ্তাহের দ্বিতীয় কাজের দিন। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ দমদম থেকে কবি সুভাষ স্টেশনের দিকে রওনা দেয়া একটি মেট্রো হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ে শোভাবাজার স্টেশনে। মেট্রো সূত্রে খবর, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই মেট্রো আটকে যায় মাঝপথে। ফলে বন্ধ করে দিতে হয় ওই রুটের পরিষেবা।
এর জেরে মেট্রোর আপ এবং ডাউনলাইনে ট্রেন চলাচল বেশ ব্যাহত হয়। অফিস টাইমে অল্প সময়ের ব্যবধানে মেট্রো থাকায় পরপর সেগুলি দাঁড়িয়ে পড়ে, যার জেরে নাজেহাল হন যাত্রীরা। মেট্রোর তরফে আংশিক পরিষেবা দেয়া হলেও সমস্যা তখনই কাটেনি।
মেট্রো সূত্র অনুযায়ী, প্রায় ঘন্টাখানেক পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়।মেট্রোরেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র বলেন, "শোভাবাজারে একটি রেক খারাপ হয়ে যায়। ব্রেকের সমস্যা হতে পারে ওই রেকে। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।"
বারবার একই ঘটনা
অতীতেও কলকাতার মেট্রোতে এরকম যান্ত্রিক ত্রুটির অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে পার্ক স্ট্রিট থেকে এসপ্ল্যানেড স্টেশনের মাঝে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা গিয়েছিল। থমকে গিয়েছিল মেট্রোরেল। তার জেরে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়েছিল।
গত ডিসেম্বর মাসে মেট্রোর ইতিহাসে ঘটে গিয়েছিল বেশ নজিরবিহীন ঘটনা। দক্ষিণেশ্বর দমদম লাইনে স্তব্ধ হয়েছিল মেট্রোপরিষেবা। ১৭ ডিসেম্বর তার জেরে বাতিল করা হয়েছিল ৮০টি ট্রেন। জানা গিয়েছিল থার্ড রেলে বিদ্যুৎ পরিষেবার বিঘ্নতেই এই বিপত্তি ঘটেছিল।
তার আগে ৫ ডিসেম্বর পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশন এর কাছে বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাতে মেট্রো পরিষেবা বিঘ্নিত হয়।
যান্ত্রিক ত্রুটি
কলকাতা মেট্রো নিয়ে অভিযোগ অনেকদিনের। অতীতে বহুবার দেখা গিয়েছে মেট্রো থেকে ধোঁয়া বার হওয়ার ঘটনা, যা যাত্রীদের আতঙ্কিত করে তোলে।
এসপ্ল্যানেড চত্বরের অফিসে কর্মরত নিত্যযাত্রী সন্দীপ সাধু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রায়ই মেট্রোতে দেরি হয়। তবে ইদানিং মেট্রোর যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য আমাদের আশঙ্কা হয় । ঠিকঠাক অফিসে পৌঁছতে পারব কিনা বা আদৌ মেট্রো থেকে সুরক্ষিত নামতে পারব তো?"
পরিবহন বিশেষজ্ঞ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অপারেশন, মেনটেনেন্স এবং সিকিউরিটি- এই তিনটি ব্যাপারে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে আরো যত্নবান হতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে মেট্রোরেলে যান্ত্রিক ত্রুটি বারবার ঘটবে আর মানুষ তার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা মাটির নিচে অপেক্ষা করবে- এটা হতে পারে না।"
তার পরামর্শ, "একটা মেট্রোর সঙ্গে আর একটা মেট্রোর সময়ের ব্যবধান যত কমবে, তত বেশি সতর্ক হওয়া উচিত কর্তৃপক্ষের। তারা ট্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াচ্ছে, অথচ মনিটরিং, রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ভাবছে না। এটা ঘটলে এই বিড়ম্বনা বাড়বে।"
প্রযুক্তি বনাম সুরক্ষা
ইতিমধ্যে গঙ্গা নদীর উপরের জলস্তর থেকে ৩৩ মিটার নীচে তৈরি হয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর জোড়া সুড়ঙ্গ। দেশে প্রথম কলকাতাতেই নদীর তলা দিয়ে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। এমনকি দিল্লির পর কলকাতাতেও চালকবিহীন মেট্রো চালানোর কথা হচ্ছে।
প্রযুক্তির কল্যাণে একদিকে যখন কলকাতার সবকটি করিডরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেট্রো চালানোর পরিকল্পনা চলছে, ঠিক এই সময়েই যান্ত্রিক ত্রুটিতে মেট্রো সফরে যাত্রী হয়রানি!
অধ্যাপক বিশ্বাস বলেন, "ছোট ছোট এই যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো থেকেই আমাদের শিখে নিতে হবে যাতে বড় বিপর্যয় না হয়। বিশেষত এরকম সময়ে যখন বাইরে ৪০ ডিগ্রির বেশি গরম। এরকম যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা মাটির তলায় ঘটলে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না থাকলে সেটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে বাধ্য।"
তার মতে, "মাটির নিচে এমন বিড়ম্বনার পরিস্থিতি তৈরি হলে যাত্রীরা শুধু বিরক্ত নয়, আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। কর্তৃপক্ষ যদি যাত্রী নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে উদাসীন হয়, যে পরিমাণ নজরদারি দেওয়ার দরকার, সেটা যদি না দেয়া হয়, তাহলে আরো বড় বড় বিপর্যয় আগামী দিনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।"
যাত্রীর দাবি
মেট্রোতে নন-এসি রেক এখন ব্যবহৃত হয় না। সব মেট্রো বাতানুকূল। সারা কলকাতা জুড়ে মেট্রো শাখার দ্রুত বিস্তার চলছে। এতে খুশি যাত্রীরা। তবে তারা নিশ্চিত হতে পারেন না।
বেলগাছিয়ার বাসিন্দা চম্পা খামরুই ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মেয়ের কলেজের পরীক্ষার দিন মেট্রোতে যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছিল। পরীক্ষার হলে দেরিতে পৌঁছেছে, অনেকটা ক্ষতি হয়েছে এতে। এই সমস্যা নির্মূল হয় না কেন?"
বয়সের ভারেও মেট্রোরেল আক্রান্ত হচ্ছে।কলকাতায় তিন দশক ধরে মেট্রো চলছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পুরনো রেকের পরিবর্তন, পরিমার্জন দরকার। পাশাপাশি সিগন্যাল ব্যবস্থা, যাত্রী সুবিধা, মেট্রোর বিদ্যুৎবাহী ট্র্যাক ইত্যাদির দিকে নিয়মিত নজরদারি দরকার।
বিদ্যুৎবাহী ট্র্যাক যেন কখনোই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।যাত্রীদের বাড়তি সুরক্ষার স্বার্থে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে আরেকটু তৎপর হয়ে ভাবতে হবে, কী করে আরো স্বাচ্ছন্দ্য যাত্রীদের দেয়া যেতে পারে। নইলে পরিষেবার বিস্তার হলেও মান উন্নত হবে না।