বেড নেই, কলকাতার হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রোগীর মৃত্যু
৭ নভেম্বর ২০২৪কেন্দ্রীয় রেফারেল ব্যবস্থা চালু করার পরও রোগীর হয়রানি কমছে না। হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে মারা গেলেন এক রোগী। তার আগে রোগীকে বাঁচাতে অসহায় পরিবার তাকে নিয়ে চলে গেল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি।
জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের অন্যতম দাবি রেফারেল ব্যবস্থা চালু করা, যাতে রোগীকে ভর্তি করার ক্ষেত্রে সমস্যা না হয়। কোনো হাসপাতাল অন্যত্র রেফার করলে রোগীকে ফিরিয়ে দেয়া না হয়, এমনটাই ছিল লক্ষ্য। রাজ্য সরকার আন্দোলনকারীদের অনেক দাবিকে মান্যতা দিলেও রেফারেল ব্যবস্থার যে পরিবর্তন হয়নি, তার প্রমাণ মিলল মঙ্গলবার।
রোগীর মৃত্যু
সোমবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন গড়িয়ার বাসিন্দা সুশীল হালদার। তার চোখ মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এন আর এস হাসপাতালে। সেখানে বেড খালি না থাকায় তাকে এস এস কে এম হাসপাতালে পাঠানো হয় সুশীল কে।
কিন্তু এই হাসপাতালে গিয়ে রোগীর পরিবার জানতে পারে, কোনো বেড ফাঁকা নেই। এস এস কে এম থেকে তাকে আবার পাঠানো হয় এন আর এস হাসপাতালে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুশীলের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। পরিবারের সদস্যরা তাকে এন আর এসে ফিরিয়ে আনলেও লাভ হয়নি। সেখানে বেড খালি ছিল না।
পরিবারের দাবি, এই সময়ে কোনো চিকিৎসা পাননি সুশীল। রাতভর তাকে ভর্তি করা নিয়ে টানাপোড়েন চলতে থাকে। দুবার করে শহরের দুই নামী সরকারি হাসপাতাল ঘোরা হয়ে গেলেও বেড পাওয়া যায়নি। রোগীর পরিজনেরা সিদ্ধান্ত নেন, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে দরবার করবেন।
মঙ্গলবার ভোরে স্ট্রেচারে করে সুশীলকে নিয়ে যাওয়া হয় কালীঘাটে। সেখান থেকে চিঠি লিখে দেয়া হয় রোগীর পরিবারকে। সেই চিঠি নিয়ে আরো একবার এস এস কে এম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীকে। সেখানে ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা শুরু হওয়ার সময়েই মারা যান সুশীল হালদার।
রেফারেল ব্যবস্থার সুবিধা
জুনিয়র চিকিৎসকরা যে ১০ দফা দাবি রাজ্যের কাছে রেখেছিলেন, তার অন্যতম কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থা চালু করা। গত পয়লা নভেম্বর থেকে কলকাতার পাঁচটি সরকারি কলেজে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আর জি কর, এন আর এস, এস এস কে এম, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার অধীনে আনা হয়। তার কয়েক দিনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে রোগী কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন।
এই ব্যবস্থা অনুযায়ী এক হাসপাতাল থেকে অন্যত্র রোগীকে পাঠালে তাকে ভর্তি নিতে হবে। যে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে, সেখানে বেড আছে কি না, তা জেনে রোগীকে পাঠাতে হবে। কিন্তু এই রোগীর ক্ষেত্রে অন্য ছবি দেখা গিয়েছে।
১৫ অক্টোবর রাজ্যে শুরু হয় সেন্ট্রাল রেফারেল সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় রেফারেল ব্যবস্থার পাইলট প্রজেক্ট। সেদিন সোনারপুর গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে এক রোগীকে এই ব্যবস্থায় এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
একটি হাসপাতাল থেকে কোনও রোগীকে অন্য মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার জন্য একটি পোর্টাল ব্যবহার করা হচ্ছে। হেলথ ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম অর্থাৎ এইচএমআইএস পোর্টাল। তার মাধ্যমেই রোগীদের অন্য হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
এই ব্যবস্থায় বার্তা চলে যাবে প্রতিটি হাসপাতালের এইচএমআইএস পোর্টালে। যে হাসপাতালে বেড খালি থাকবে, সেখানকার কর্তৃপক্ষ রেফার হওয়া রোগীকে ভর্তি নিতে পারবে। এর ফলে একাধিক রোগীর পরিবার এই ব্যবস্থার মাধ্যমে লাভবান হবে। এরই সঙ্গে হাসপাতালে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে লাগাম কষা যাবে দালাল চক্র। বাইরে থেকে সুপারিশের মাধ্যমে রোগী ভর্তি করানো যাবে না।
সফল হবে রেফারেল?
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের আরো দাবি ছিল, বেড ভ্যাকেন্সি মনিটর চালু করতে হবে, যা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শুরু করা হয়েছে। রেফারেল ব্যবস্থা সাফল্য পেলে, পরবর্তী ধাপে বেড ভ্যাকেন্সি মনিটর সর্বশেষ তথ্যের সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে।
কিন্তু এখনো কেন্দ্রীয় রেফারেলের সাফল্য যে অনেকটা দূরে, তা বুঝিয়ে দিল সুশীল হালদারের মৃত্যু। পর্যাপ্ত পরিকাঠামো তৈরি না হলে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র চিকিৎসক অর্ণব তালুকদার ডিডব্লিউকে বলেন, "এই ঘটনা আমাদের দাবির নায্যতা প্রমাণ করছে। মুখে বা খাতায়-কলমে বললেও সরকার আদতে কিছুই চালু করেনি। যে তিমিরে রোগীরা ছিল, তারা সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।"
তার অভিজ্ঞতা, "আমরা মেডিক্যাল কলেজে ডিউটি করতে এসে দেখতে পাচ্ছি যে, কলেজগুলিতে কম্পিউটার এবং স্ক্রিন বসানো হচ্ছে। অবশ্য এগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছে না। রোগী, রোগীর বাড়ির লোক এবং আমরা ডাক্তাররাও সেখান থেকে বেড দেখতে পাচ্ছি না। ফলে জানতেও পারছি না যে কোথায় কতগুলো বেড আছে বা কোথায় রেফার করলে সুবিধা হয়।"
চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সভাপতি তথা ছ'টি চিকিৎসক সংগঠনের যৌথ মঞ্চের অন্যতম কর্তা কৌশিক চাকী ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই ঘটনা স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো। বেড পেলে ডাক্তার থেকে প্যারামেডিক্যাল স্টাফ, সবাই সার্ভিস দেবে। কিন্তু বেড না পেলে তারা কী করবে? বেড জোগাড় করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের, চিকিৎসক বা নার্সদের নয়। শুধু এই কথাটা বোঝাতে তিন মাস আন্দোলন আর ১৭ দিনের অনশন করতে হল।"
সরকারের তরফ থেকে রেফারেল সিস্টেম চালু যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল তাকে ডাক্তার চাকী "পর্বতের মূষিক প্রসব" বলে দাবি করেন।
যদিও স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর, দ্রুত এই ব্যবস্থা কার্যকর করার চেষ্টা চলছে। একদিনে এটা হয়ে ওঠে না, কিছুদিন সময় লাগে। শুধু এই ব্যবস্থা নয়, অন্যান্য দাবি পূরণের লক্ষ্যে কাজ চলছে।
আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসক রুমেলিকা কুমার বলেন, "এ দিনের ঘটনা থেকে প্রমাণিত, সেন্ট্রাল রেফারেল ব্যবস্থার পাইলট প্রজেক্ট ব্যর্থ। কেন হাসপাতালে বেড পাওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হবে? বৈঠকে আমাদের বলা হয়েছে, কাজ চলছে। কাজটা কবে শেষ হবে, আমরা তার সঠিক সময় জানতে চেয়েছিলাম।"
সিনিয়র চিকিৎসক কুণাল সরকার বলেন, "আমরা একটা নিম্ন আয়ের সমাজে বাস করি। চিকিৎসা পরিষেবার পিছনে সরকার যা খরচ করে, তা পর্যাপ্ত নয়। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে সফটওয়্যার তৈরি, সবেতেই খরচ করতে হয়। এই ব্যয় পর্যাপ্ত না হলে পরিকাঠামো ঠিকঠাক গড়া যাবে না।"
অর্ণবের প্রশ্ন, "সরকার চাইলে এই ব্যবস্থা আরো স্বচ্ছ করতে পারে। কোভিডের সময় রাজ্য জুড়ে কোন রোগী কোথায় গেলে বেড পাবে, এটা খুব সুষ্ঠুভাবে করা হয়েছিল। তবে এখন কেন করা হচ্ছে না?"