1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ব্যাংকে টাকা রাখলে কমে যাওয়ার শঙ্কা

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখে মুনাফা পাওয়ার আশায়৷ কিন্তু কম সুদ হার আর মূল্যস্ফীতির ঊর্দ্ধগতির কারণে বছর শেষে টাকা পাওয়া যাবে তাতে প্রকৃত আয় কমে যেতে পারে৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর ফলে মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমবে৷

https://p.dw.com/p/3Xw2Z
Bangladesch Banknoten in Dhaka
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images

সরকারি, বেসরকারি, বিদেশি মিলিয়ে বাংলাদেশে ৫৮ টি ব্যাংক রয়েছে৷ তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন সুদ হারে আমানতের প্যাকেজ আছে৷ এর মধ্যে ১৬ টি ব্যাংকের গড় সুদ হার ৫ ভাগের নীচে৷ ৩১ টি ব্যাংকই সুদ দিচ্ছে ছয় ভাগের কম৷ সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী, জনতা, রূপালি ও সোনালী ব্যাংকের গড় সুদ হার চার থেকে সাড়ে চার ভাগের মতো৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে দেশে ব্যাংক খাতে আমানতের বিপরীতে গড় সুদ হার পাঁচ দশমিক সাত ভাগ৷ অন্যদিকে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হারও দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ ভাগের বেশি৷ এ কারণে ব্যাংকে টাকা রেখে সঞ্চয়কারীরা এখন আর প্রকৃত অর্থে লাভবান হতে পারছেন না৷ বরং তাদের জমা করা টাকার মূল্যমান বা আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে৷

ধরুন ব্যাংকে কেউ ১০০ টাকা জমা রেখেছেন৷ সুদ হার ছয় ভাগ হলে বছর শেষে তিনি ১০৬ টাকা পাবেন৷ কিন্তু মূল্যস্ফীতির হারও যদি ছয় ভাগ হয় তাহলে ১০০ টাকায় এখন যেই পণ্য বা সেবা পাওয়া যায় বছর শেষে তার জন্য ১০৬ টাকা খরচ করতে হবে৷ সেক্ষেত্রে ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সেই টাকা থেকে কোনো আয় হবে না আমানতকারীদের৷ 

সালেহউদ্দিন আহমেদ

এই অবস্থাকে সঞ্চয়ের জন্য মোটেও অনুকূল নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘এর অর্থ হলো মানুষের টাকা নাই হয়ে যাচ্ছে৷ দরিদ্র, মধ্যবিত্ত তাদের মূল সম্পদ হচ্ছে টাকা৷ তাদের সঞ্চয়ের অভ্যাস কমে যাবে৷ ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স যাকে বলছি, সেটা কমে যাবে৷''

এখন ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক নীতি অনুযায়ী সুদ হার নির্ধারণ করে৷ এপ্রিল থেকে সেই সুযোগও তারা হারাবে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, তখন কোনো ব্যাংকই আমানতকারীদের ছয় ভাগের বেশি হারে সুদ দিতে পারবে না৷ এর ফলে সঞ্চয়কারীদের আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে৷ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন,  ‘‘প্রথমত সুদের হার বেঁধে দেয়াটা কোনোভাবেই যৌক্তিক না৷ বলতে পারতো স্প্রেড (আমানত ও ঋণের সুদ হারের ব্যবধান) কমাও৷ এর প্রভাব পড়বে আমাদের সঞ্চয়ের উপরে৷ এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে৷''

তবে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত মনে করেন, ‘‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে (আমানতকারীর) রিয়েল ইনকাম কমবে না৷ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অবশ্যই তাদের প্রকৃত আয়টা তখন কমে যাবে৷'' 

শেয়ার বাজারে আস্থার সংকট

বিশ্বের অনেক দেশেই শেয়ার বাজার শক্তিশালী৷ সেখানে ব্যাংকে টাকা রাখার বদলে মানুষ আয়ের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু বাংলাদেশে শেয়ার বাজার কখনোই শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়ায়নি৷ তার উপর আছে কারসাজি করে দাম বাড়ানো কিংবা কমানোর অভিযোগ৷ এর ফলে শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়ে বরং পথে বসতে হয়েছে অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারীকে৷ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শেয়ার বাজারের পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে৷

এক বছর আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ছিল প্রায় চার লাখ ১৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা৷ ১৮ ফেব্রুয়ারিতে এসে তা তিন লাখ ৫৬ হাজার ১৬০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে৷ অর্থাৎ, এক বছরেই বাজার থেকে উধাও হয়েছে ৫৮ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা৷     

গত কয়েকদিনে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও এক বছরের ব্যবধানে সূচকের পতনটাও উল্লেখ করার মতো৷ গত বছর একই দিনে ডিএসইএক্স যেখানে পাঁচ হাজার ৭২৪ পয়েন্ট ছিল এখন তা নেমে এসেছে  চার হাজার ৭৪০-এ৷ 

জায়েদ বখত

সঞ্চয়পত্রে বাধা 

ব্যাংকের সুদ হারের সাথে বড় ধরনের তফাতে গত কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের টাকা জমা রাখার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছিল সঞ্চয়পত্র৷ গত কয়েকটি অর্থবছরে এর বিক্রি সরকারের বাজেটে ধরা লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে৷ রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে তাই বছর বছর সুদ পরিশোধের চাপও বাড়ে৷ এমন অবস্থায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির রাশ টানার পদক্ষেপ নেয় সরকার৷ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে টিআইএন ও ব্যাংক হিসাব বাধ্যতামূলক করা, অনলাইনে আবেদনের পাশাপাশি উৎসে করের হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়৷

সরকারের এসব পদক্ষেপের প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে৷ চলতি অর্থবছরে যেখানে ২৭ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার, সেখানে বছরের অর্ধেকে ৫ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা এসেছে এই খাত থেকে৷ অথচ গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই বিক্রি হয়েছিল ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র৷ 

এরপরও সম্প্রতি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদ হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ৷ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের আস্থার একটি জায়গা ছিল এই স্কিমটি৷ এখন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, ‘‘একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের উপরে ডিপোজিট রাখতে গেলে সেটার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা যেতো৷ কিন্তু ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা, যারা যেসব জায়গায় ডাকঘর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তারা যদি এখানে সঞ্চয় করে থাকে, সেই ক্ষেত্রে এই  ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা সুদের হার এক লাফে অর্ধেক করে ফেলার কারণে অবশ্যই বিপাকে পড়বেন৷''

অন্যদিকে সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সরকারের রাজস্ব আয় কম দেয়ার মাশুল গুনতে হচ্ছে গরিব মানুষকে৷ ‘‘যুক্তি দেয়া হচ্ছে, এর পেছনে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু এই টাকা তো সাধারণ মানুষের ট্যাক্স বা রাজস্ব আয় থেকেই যাচ্ছে৷ তাহলে আপনি দরিদ্র মানুষকে কেন এর জন্য শাস্তি দেবেন৷ রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার দোষ তো আর তাদের না৷'' 

তার মতে, সঞ্চয়পত্র অনেকে অপব্যবহার করেছে, সেটা হয়তো সংশোধন করা যেতো৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সুদের হার কমিয়ে দিতে হবে৷ এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের যে টাকা রাখার প্রবণতা আর নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের উপার্জনের বিষয়টি মোটেও বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷   

সাধারণ মানুষ কোথায় টাকা রাখবেন? 

এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ আসলে কোথায় টাকা খাটাবেন সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে৷ সুদ যত কমই হোক এই মুহূর্তে ব্যাংকে টাকা রাখা ছাড়া মানুষের সামনে আর কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন জায়েদ বখত৷ তিনি বলেন, ‘‘মানুষের হাতে আর কোনো অপশন নেই৷ মানুষ তো ঘরে টাকা ফেলে রাখবেন না৷ বিভিন্ন ব্যাংকিং সার্ভিসও নেয়ার বিষয় আছে৷ এটা যে খুব একটা বেশি সঞ্চয় ডাইভার্ট করবে তা মনে হয় না৷ কারণ, ডাইভার্ট করে সঞ্চয় তো অন্য জায়গায় নেয়ার সুযোগ নেই৷''

তবে তার সঙ্গে একমত নন সালেহউদ্দিন আহমেদ৷ তিনি মনে করেন, ‘‘সাধারণ মানুষের এখন টাকা রাখার জায়গা কোথাও নেই৷'' এ কারণে বাংলাদেশের মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমবে৷ তারা ব্যাংকে টাকা রাখার উৎসাহ হারাবেন৷ বেছে নেবেন টাকা রাখার প্রথাগত পদ্ধতিগুলো, যা শেষ পর্যন্ত তৈরি করবে তারল্য সংকট, নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য