ভারতে ঘূর্ণিঝড় বরদার তাণ্ডব
১৪ ডিসেম্বর ২০১৬বঙ্গোপসাগরের প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় বরদা ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে দক্ষিণ ভারতের উপকূলবর্তী তামিলনাড়ুর চেন্নাইতে আছড়ে পড়ার পর, গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে জনজীবন একেবারে স্তব্ধ হয়ে পড়ে৷ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় জানমালের৷ অবশ্য ধীরে ধীরে ঝড়ের গতিবেগ কমে আসছে বলে জানা গেছে৷
ঘূর্ণিঝড়ে চেন্নাই মহানগরীর সঙ্গে আশেপাশের শহরগুলির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ ব্যাংকিং পরিষেবা, ক্যাশলেস বা নগদহীন পরিষেবা অচল হয়ে পড়ে৷ রেল, বিমান ও সড়ক যোগাযোগ হয় বিপর্যস্ত৷ জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ শেষ পাোয়া খবর অনুযায়ী, তামিলনাড়ুর সমুদ্র উপকূল থেকে মত্সজীবীদের উদ্ধার করা হয়েছে৷ তবে বৃষ্টিপাতসহ এই ঘূর্ণি ঝড়ের ফলে রাজ্যের জলাভাব কিছুটা হলেও কম হবে বলে জল-পরিচালন কর্তৃপক্ষ আশা করছেন৷
চেন্নাই-এর বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমান মেডিক্যাল ক্যাম্প খোলা হয়েছে জলবাহিত অসুখ-বিসুখের চিকিত্সার জন্য৷ ট্রেন ও বিমান চলাচল ফের শুরু হয়েছে আংশিকভাবে৷ অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরুদ্ধার করার কাজ চলেছে৷ হাসপাতালগুলিতে ডিজেল জেনারেটর ও ব্যাটারি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে৷ তামিনাড়ুতে দশ হাজার মানুষকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে৷ খোলা হয়েছে প্রায় ৩০০ ত্রাণ শিবির৷ বর্তমানে জনজীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে, এমনটাই দাবি করছে প্রশাসন৷
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু সরকারি আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছেন, জলাধারগুলিতে যেন ফাটল না ধরে বা জল যাতে ধরে রাখা যায় তার উপযুক্ত জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য৷ অন্ধ্রপ্রদেশ এবং দরকার হলে তামিলনাড়ুকেও যেন ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে সহায়তা করা হয়৷ অন্ধ্রের ৩০টি উপকূলবর্তী গ্রামে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে৷ প্রায় হাজার পঞ্চাশেক পরিবারকে অন্য নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে৷ ব্যাঙ্গালুরু এবং তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঝড় ও বজ্রবিদ্যুতসহ প্রবল বৃষ্টি হতে পারে৷ এক জরুরি বৈঠকে কর্নাটক রাজ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য বিশেষ দলকে তৈরি রাখা হয়েছে৷
তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে কেন? ভূ-বিজ্ঞান ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত এক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের জলস্তরের উষ্ণতা গত ৩০ বছরে ক্রমাগত বেড়ে চলার ফলে বরদার মতো সাইক্লোন ঘন ঘন উষ্ণমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে ভারতের উপকুলবর্তী রাজ্যগুলিতে তাণ্ডব চালাবে৷ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞানী অধ্যাপক আশুতোষ মিশ্র উষ্ণমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের গত ১২২ বছরের ডেটা বা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, প্রতি বছর মে, অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর, এই চার মাসে বিশেষ করে তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্রপ্রদেশে বরদার মতো প্রচণ্ড সামু্দ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ এরমধ্যে সবথেকে বেশি হবার আশংকা সাধারণত নভেম্বর মাসে৷ গড়ে পাঁচ থেকে ছ'বার৷ এমনকি আরব সাগরেও অপেক্ষাকৃত কম তীব্রতার বারংবার ঘূর্ণিঝড় হবার আশংকা আছে৷ প্রশান্ত মহাসাগরীয় জলস্তরের উষ্ণতা বৃদ্ধিই এর কারণ৷ ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন বিশেষ করে উপকূলবর্তী অঞ্চলে দ্রুত শিল্পায়নও এর বড় কারণ৷
ঘূর্ণিঝড়ের বরদা নামটা পাকিস্তানের দেওয়া৷ এই উর্দু শব্দের অর্থ লাল গোলাপ৷ ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলের যে আটটি দেশ – ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মলদ্বীপ ও ওমানের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরের উষ্ণমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়, সেইসব দেশের আদ্যাক্ষর দিয়ে এই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের একটা রীতি চালু হয় ২০০৪ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার বৈঠকে৷ ভারতের দেওয়া নামের তালিকায় আছে, অগ্নি, বিজলি, আকাশ, জল, লেহর, মেঘ, সাগর ও বায়ু. বিশেষ নামকরণের উদ্দেশ্য, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের বদলে একটা বিশেষ নাম দিলে মানুষ ও প্রচার মাধ্যম সেই ঘূর্ণি সামুদ্রিক ঝড়ের ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা মনে রাখতে পারবে৷ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হ্যারিকেন স্যান্ডি, ক্যাটরিনা৷ হ্যারিক্যান, টাইফুনের সঙ্গে বরদা ঘূর্ণিঝড়ের পার্থক্যটা কী? হ্যারিক্যান উঠে অ্যাটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর থেকে টাইফুন উত্তর-পশচিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে এবং সাইক্লোন দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর থেকে আর বরদা উঠেছে বঙ্গোপসাগর থেকে৷