সাংবাদিক গ্রেপ্তার
২৩ জানুয়ারি ২০১৯সরকারের সমালোচনা করে কারাবন্দি হওয়ার ঘটনা ভারতে নতুন নয়৷ ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে জরুরি অবস্থা থেকে আজকের নরেন্দ্র মোদীর রাজত্ব পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত৷ কলকাতায় অম্বিকেশ মহাপাত্রর কথা মনে আছে? সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্টুন ফরোয়ার্ড করে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল তাঁকে৷ সাধারণ মানুষ তো বটেই, শাসকের রোষানলে পুড়তে হয়েছে সাংবাদিকদেরও৷
সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরে খুন হতে হয়েছে কর্ণাটকের সাংবাদিক গৌরি লঙ্কেশকে৷ আরো এক উদাহরণ উত্তর-পূর্ব ভারতের অঙ্গরাজ্য মণিপুরের এক সাংবাদিক কিশোরচাঁদ ওয়াংখেম৷
ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষে অবশ্য বলা হচ্ছে, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্বেষ ছড়ানোর নাম সংবাদ নয়৷ মণিপুরের জনতার মনে দেশের অন্য প্রান্তের মানুষদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ তৈরি করা ওই সাংবাদিকের উদ্দেশ্য৷ তাছাড়া শুধু এই ভিডিওবার্তাই নয়, এর আগেও দেশ-বিরোধী নানা মন্তব্য করেছেন কিশোরচাঁদ৷ আগেও কারাবাস করেছেন৷'' এদিকে, সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ঘিরে রাজনীতির পারদ চড়ছে৷ কারাবন্দি সাংবাদিককে চিঠি লিখেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী৷ তাতে তিনি লিখেছেন, ‘‘শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি মানুষের সাধারণ অধিকার কেড়ে নিচ্ছে৷ তার এক উদাহরণ আপনি৷ ফ্যাসিস্টরা ভারতের দর্শন ধ্বংস করেও ক্লান্ত নয়৷ আপনার মতো যাঁরা রুখে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের জেলবন্দি করা হচ্ছে৷''
সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্টুন ফরোয়ার্ড করার জেরে একইভাবে শাসকের রোষে পড়ে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে৷ তুমুল ঝড় বয়ে গিয়েছিল বাংলার রাজনীতিতে৷ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল মমতা ব্যানার্জির সরকারকে৷
কিশোরচাঁদের ঘটনায় ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অম্বিকেশ বললেন, ‘‘সাংবাদিককে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করা সংবিধান স্বীকৃত মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার হরণের ঘটনা৷ মানবাধিকারের ওপর আক্রমণ৷ তবে, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ সারা দেশে এমন ঘটনা ঘটছে৷ আমার ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল৷ শাসক দল অনবরত এই ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে৷ দল, মত নির্বিশেষে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন৷ দুঃখের বিষয় হলো, বহু লড়াই আন্দোলন করে শাসক দলে পরিণত হওয়ার পরেও একই ঘটনা ঘটে৷''
৩৯ বছরের কিশোরচাঁদ কাজ করতেন আইএস টিভিতে৷ সেখানে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি৷ তারপরই নরেন্দ্র মোদী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে সুর চড়ান৷ গত ১৯ নভেম্বর ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের জন্মদিন উদযাপন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুলেছিলেন স্থানীয় এক টিভি চ্যানেলের ওই সাংবাদিক৷ ফেসবুকে ভিডিও বার্তায় কিশোরচাঁদ বলেছিলেন, ‘‘রাজপুত যোদ্ধা রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের মণিপুরে বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও মণিপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভুলে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে তাঁর জন্মবার্ষিকী উদযাপন করছে রাজ্য সরকার৷'' এজন্য তিনি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে ‘নরেন্দ্র মোদীর হাতের পুতুল' এবং ‘হিন্দুত্বের পুতুল' বলেও কটাক্ষ করেছিলেন৷ ব্যাস! তার জেরে পরদিনই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইনে' গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিশোরচাঁদকে৷ এর প্রতিবাদে সরব হয়েছে ‘প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া' এবং ‘ইন্ডিয়ান জার্নালিস্টস ইউনিয়ন'৷ তবে এই নিয়ে উচ্চবাচ্চ করছে না ‘অল মণিপুর ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস ইউনিয়ন'৷
প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার সদস্য দিল্লিতে কর্মরত সাংবাদিক জয়শঙ্কর গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘গণতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভিন্নমত পোষণের অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এই দুই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই গণতন্ত্র মজবুত হয়৷ অতীতে জরুরি অবস্থার সময় থেকেই ভিন্নমতকে দমন করার চেষ্টা চলে আসছে৷ মণিপুরে যা ঘটেছে, তা সত্যিই হাস্যকর ও নিন্দনীয় ঘটনা৷ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা নিয়ে নিবারণের ব্যবস্থা আছে৷ তা সত্ত্বেও তাঁকে ফৌজদারি আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ আসলে ভারতে ঘোষিত না হলেও অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে৷ এখন বিষয়টি প্রেস কাউন্সিলের কাছে এলে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে৷''
গত ২৭ নভেম্বর প্রথমে তাঁকে আটক করে মণিপুর পুলিশ৷ ওই সাংবাদিকের কর্মকাণ্ডে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, এমন অভিযোগ করে পুলিশ ও মণিপুর সরকার৷ রাজ্যপাল নাজমা হেপতুল্লা ওই সাংবাদিকের গ্রেপ্তারিতে সম্মতি দেন৷ জাতীয় নিরাপত্তা আইনে এক বছরের কারাদণ্ড হয়েছে ওয়াংখেমের৷