1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভুয়া, উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং মিথ্যা খবর

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মার্কিন নির্বাচনের সময় ভুয়া খবরের বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে৷ এমন খবর তৈরির পেশাদারদের পাশাপাশি তাদের ভালো আয়ের কথাও উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমে৷ অ্যামেরিকারই যখন এই অবস্থা, তখন বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম কোথায় দাঁড়িয়ে?

https://p.dw.com/p/2XNxm
Symbolbild Fake News im Netz
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gabbert

গত ১৭ অক্টোবর ভোর রাতে বাংলাদেশের বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ এবং সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ও সাম্প্রদয়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চের নেতা কমরেড অজয় রায় মারা যান৷ খবরটি সেলফোনের এমএমএস-এর মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা বাপ্পাদিত্য বসু৷ কিন্তু কয়েকটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে ছবিসহ ছাপা হয়, ‘‘ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় আর নেই৷''  তারা অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়ের ছবিও ব্যবহার করে৷ এ নিয়ে তখন বাপ্পাদিত্য বসুর সঙ্গে যোগোযোগ করলে তিনি তাঁর করা টেক্সট মেসেজটি ডয়চে ভেলে'র ঢাকা প্রতিনিধিকেও পাঠিয়েছিলেন৷ তাতে বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন এবং সাম্প্রদয়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চের নেতা অজয় রায়ের মৃত্যুর খবরই সবিস্তারে দেয়া হয়েছিল৷

বাপ্পাদিত্য তখন এর প্রতিক্রিয়ায় ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধিকে বলেন,‘আমি সাংবাদিক এবং পরিচিত জনদের এসএমএসটি দিয়েছি৷ কিন্তু তাতে স্পষ্ট করেই কমরেড অজয় রায়ের পরিচয় দেয়া আছে৷ তারপরও দু-একটি সংবাদ মাধ্যম কিভাবে আমাকে উদ্ধৃত করে নিহত ব্লগার অভজিৎ রায়ের বাবার মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন করল বুঝতে পারছি না৷

এই ঘটনাটিকে সাংবাদিকের অসতর্কতা বা অদক্ষতার ফল বলা যায়৷ খবরটি সত্যও নয়৷ তারপরও এই খবরটিকে তৈরি করা ‘ভুয়া খবর' বলা যাবে বলে মনে হয়না৷

Robeyet Ferdous - MP3-Stereo

কখনো ভুল করে ভুল সংবাদ পরিবেশন আর কখনো ইচ্ছে করে পাঠক আকর্ষণ করতে খবরে রঙচঙ লাগানো এবং ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লেখার প্রবণতা বাংলাদেশে আছে৷ আর এমনও হয় খবরের শিরোনামের সঙ্গে আসল খবরের কোনো মিল নেই৷ এর বাইরে সাংবাদিকতার নীতিমালা ভঙ্গ করে বা না মেনে বাংলাদেশে খবর পরিবেশনের নজিরও অনেক৷ হলুদ সাংবাদিতারও অভিযোগ আছে৷ তবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুয়া খবর তৈরি এবং তা প্রচার বাংলাদেশে হয় এর কোনো  শক্ত প্রমান নেই৷

অভিযোগ আছে, তবে সেই অভিযোগের একটা সাধারণ চেহারাও আছে৷ আর তা হলো, কোনো খবর যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যায়, তখন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খবরটি ‘ভুয়া' , উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন বলে অভিযোগ করেন৷ তবে বোঝাই যায়, এই ধরণের অভিযোগ ঢালাও এবং প্রমানহীন৷

গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে ভুল খবর প্রকাশকে কেন্দ্র করে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলামেইল ২৪ডটকমের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব৷ ওই ঘটনায় তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলাও হয়৷ মামলার এখনো নিস্পত্তি হয়নি৷

গত বছরের জুন মাসে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে একটি খবর প্রকাশের পর দু:খ প্রতাশ করে বিবিসি বাংলা বিভাগ৷ ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে জয়ের কথিত বৈঠকের খবর প্রচার করে পরে তারা ওই খবরের জন্য দু:খ প্রকাশ করে এবং সম্পাদকীয় নীতিমালা আরো জোরদার করার কথা জানায়৷

তবে কখনো কখনো বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ অবশ্য সেটা ওই খবরকে ‘ভুয়া' প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট নয়৷ তাছাড়া অনেক সময় সংবাদ মাধ্যমও তার তথ্যের যথার্থতা নিয়ে সন্দিহান থাকে৷ আবার এই সন্দেহ নিয়ে সেই তথ্য প্রকাশও করে, যা দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম নিজেই স্বীকার করেছেন

তিনি স্বীকার করেছেন, ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনৈতি নেতাদের নিয়ে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রতিবেদনের তথ্যের সত্যতা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করা যায়নি৷ আর ওই তথ্য ছিল আরোপিত৷গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে তিনি এভাবে সংবাদ পরিবেশন করাকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পাদকীয় ভুল হিসেবেও উল্লেখ করেন৷

তবে সম্পাদক মাহফুজ আনাম যে ধরণের ভুলের কথা বলেছেন, তখন বলতে গেলে বাংলাদেশের পুরো সংবাদ মাধ্যমই এই ‘ ভুল' করেছে৷ যদিও অন্যরা কখনো সেটা স্বীকার করেনি৷ তাই বলে বাংলাদেশে এ ধরণের সরবরাহ করা খবরের যুগ যে শেষ হয়েছে, তা বলা যাবেনা৷

এদিকে মন্ত্রী এমপিরা সময় সময় সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে ‘ মিথ্যা ও ভুয়া' খবর পরিবেশনের অভিযোগ তোলেন৷ সর্বশেষ বাংলাদেশ অবজার্ভার পত্রিকার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে পত্রিকার সম্পাদক  ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে সংসদদে তলবের দাবি জানিয়েছেন সরকার দলীয় দুই সংসদ সদস্য৷ তাঁরা  হলেন শামীম ওসমান এবং এনামুল হক৷ দু'জনই বলেছেন, ওই পত্রিকায় তাঁদের নিয়ে মনগড়া ও মিথ্যা সংবাদ প্রচারিত হয়েছে৷ 

এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত বছরের মার্চে তাঁর বিরুদ্ধে দু'টি পত্রিকার অনবরত ‘মিথ্যা' লেখার অভিযোগ তোলেন সংসদে৷ তিনি তখন বলেন, ‘‘সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ‘মিথ্যা' লিখে আমাকে গ্রেপ্তারের পথ তৈরি করেছিল৷''

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে মিথ্যা, ভুয়া বা উদ্দেশ্যমূলক  খবর পরিবেশনের অভিযোগ আছে৷ আবার সংবাদ মাধ্যমকে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো অংশ ফরমায়েশি খবর প্রকাশে বাধ্যও করে৷ কখনো কখনো খবর প্রকাশ না করতেও বাধ্য করে৷ তাই এটা কোনো সংবাদ মাধ্যম যেমন নিজ উদ্যোগেই করে, আবার কেউ করতে বাধ্যও হয়৷

তবে ‘চিত্র নায়িকা পপি অন্ত:সত্বা'- খবরের এই শিরোনাম বাংলাদেশের কোনো সংবাদ মাধ্যমকে কেউ করতে বাধ্য করে না৷ তাহলে অবিবাহিত নায়িকাকে কেন অন্ত:সত্বা বানায় কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যম? স্রেফ পাঠক টানতে তারা এটা করেন৷ নাটকের বিষয়কে এমনভাবে পরিবেশন করেন, যেন বাস্তব!

বাংলাদেশের অনেক বড় সংবাদ মাধ্যমও এই কাজ করে৷ যেমন গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের একটি পাঠকপ্রিয় বাংলা দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন শাকিব!' বিষয়টি ছিল, সাকিবকে কক্সবাজারে নামিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় এবজন নিহত হন৷ আর ওই হেলিকপ্টারে তখন শাকিব ছিলেন না এবং তার থাকার কথাও ছিলনা৷ তারপরও শাকিবের ইমেজ বিক্রি করে পাঠক ধরার চেষ্টা৷

বাংলাদেশে একটি আলোকচিত্র নিয়ে বিতর্ক চলছে কয়েকযুগ ধরে৷ আর সেই আলোকচিত্রটি হলো ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময়ে রংপুরে জাল পরা বাসন্তির ছবি৷ ছবিটি তুলেছিলেন ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ৷ ২০১৩ সালে আফতাব আহমেদ মারা যান৷ তবে বিতর্ক শেষ হয়নি৷ বাসন্তি এখনো বেঁচে আছেন৷ তাঁর অর্থিক অবস্থা আগের মতোই আছে।৷কেউ বলছেন, চিলমারীর বাসন্তিকে জাল পরিয়ে ছবি তোলা হয়৷ কেউ বলেন, ওটা আসলেই তেমন করে তৈরি করা ছবি নয়৷

Naim Nizam - MP3-Stereo

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েৎ ফেরদৌস মনে করেন, ‘‘ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের মেইন স্ট্রিম সংবাদ মাধ্যমে ফেক বা ভুয়া খবরের প্রবণতা নাই৷তবে অদক্ষ এবং উদ্দেশ্যমূলক খবরের প্রবণতা আছে৷''

তিনি বলেন, ‘‘একটি খবর পরিবেশনের আগে যেসব দিক দেখা উচিৎ, যেসব বিষয় পরীক্ষা করা উচিৎ, তা অনেক সময় করা হয়না৷ ফলে একপেশে বা মানহীন খবর আমরা দেখতে পাই৷ আবার বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের মালিক শিল্প গ্রুপগুলো হওয়ায়, তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে যেমন খবর পরিবেশন করে তেমনি, ব্যবসায়িক স্বার্থে খবর প্রকাশে বিরতও থাকে৷ এমনকি সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করে এক শিল্প গ্রুপ আরেক শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধেও খবর পরিবেশন করে৷''

রোবয়েক ফেরদৌস বলেন, ‘‘আমার দেশ পত্রিকার ভুয়া খবর ছড়ানোর ইতিহাস আছে৷ এই পত্রিকাটি মানবতাবিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর কাবা শরিফের ছবি বিকৃত করে ছেপেছিল৷ বলেছিল, গিলাফ পরিবর্তনের সময় কাবা শরিফের ইমামরা এই বিচারের প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷''

অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন'-এর সম্পাদক নঈম নিজাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারের বিরুদ্ধে বা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হলে বা তাদের স্বার্থের জন্য হানিকর কোনো তথ্য প্রকাশ করলে, তারা সেইসব খবরকে মিথ্যা বা ভুয়া বলে অভিহিত করতে চায়৷ এটা সব সময়ই হয়েছে৷''

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম, বিশেষ করে মেইন স্ট্রিম সংবাদ মাধ্যম সব সময়ই সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের চেষ্টা করে৷ তবে অনলাইনের এই যুগে তার অনেকটা বিচ্যুতি হয়েছে৷ ভালো অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে, তবে কিছু অনলাইন আছে, যারা ভুয়া খবর ছড়ায়৷ অসত্য খবর দেয়৷''

নঈম নিজাম আরো বলেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নানা ধরণের গুজব ছড়ানো হয়৷ চট্টগ্রামের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার উস্কানি দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে৷''

অধ্যাপক রোবায়েৎ ফেরদৌস বলেন, ‘‘নানা সময় সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে কিছু মিথ্যা ছবি ও তথ্য ছড়ানো হয়৷ আবার কেউ কেউ এটা ব্যবহারও করেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সম্পর্কে পারসেপশন তৈরির জন্য নানা ধরনের কথিত জরিপ তৈরি করেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া হয়৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন মন্তব্যে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য