1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভোক্তা অধিকার চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

২৯ জুলাই ২০২২

রেলের টিকিট নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদ করে এই সময়ে আলোচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। তিনি ভোক্তা অধিদপ্তরে মামলা করে জয়ীও হয়েছেন।

https://p.dw.com/p/4EtEK
Bangladesch | Verbraucher Rechte
ছবি: Mortuza Rashed/DW

রেলের টিকিটের দায়িত্ব পাওয়া আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভোক্ত অধিদপ্তর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভোক্তা অধিপ্তর ভোক্তাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষণ করতে পারে। তাদের আইনগত ক্ষমতাওবা কতটুকু।

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এন শফিকুজ্জামান জানান, "রেলের ওই ঘটনার পর আমরা ওই সেক্টর থেকে প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি। আমরা এখন সেগুলোর দিকে বেশি নজর দিচ্ছি।”

তার কথা, "ওই ঘটনায় আমরা জরিমানা করায় যাত্রীরা আস্থা পেয়েছেন। তারা মনে করছেন, অন্তত অভিযোগ জানানোর একটি জায়গা আছে।”

শুরুতে ভোক্তারা এই অধিদপ্তরের কাজ সম্পর্কে তেমন না জানলেও এখন আগ্রহী হচ্ছেন। ভোক্তা অধিদপ্তরে গত চারমাসের মধ্যে দুইটি মামলা করেছেন পলাশ মাহমুদ। এর আগে পাউরুটির দাম বেশি রাখায় তিনি মামলা করে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। জরিমানার শতকরা ২৫ ভাগ টাকা তিনি পেয়েছেন বলে জানান। 

তিনি সম্প্রতি ‘দারাজ' এবং কাঁটাবনের একটি ক্রেস্ট তৈরির দোকানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। দুইটি অভিযোগেরই একবার করে শুনানি হয়েছে। আশা করছেন জিতবেন।

ঢাকার আরেকজন ভোক্তা সালমান তারেক শাকিল জানান, ২০১৭ সালে এক বোতল পানির দাম ফাস্ট ফুডের দোকানে  বোতলের গায়ে লেখা দামের চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি রাখায় তিনি মামলা করেছিলেন। তিনি বলেন, "আমি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করাতে সক্ষম হয়েছিলাম। মামলা ১৫ দিনে নিস্পত্তি হয়েছিল।”

এই দুইজন জানান," প্রতিকার পেতে হলে প্রোপার ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করতে হবে। পণ্য কেনার রসিদ, ওয়ারেন্টির কাগজ বা অন্যকোনো ডকুমেন্ট। তা না হলে অভিযোগ প্রমাণ কঠিন।”

অভিযোগ অনলাইন ও সরাসরি দুইভাবেই করা যায়। ফরম  অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেই আছে। অভিযোগ যথাযথভাবে দায়ের করলে অধিদপ্তর থেকেই শুনানির তারিখ জানানো হয় দুই পক্ষকে। এরপর একজন কর্মকর্তার সামনে শুনানি হয়।

কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)  সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, "ভোক্তা অধিদপ্তরের অনেক সীমাবদ্ধতার পরও তাদের বড় সাফল্য হলো ভোক্তারা এখন জানতে শুরু করেছে যে তাদেরও অভিযোগ জানানোর  একটা জায়গা আছে।”

আইন ও কাঠামো 

২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ভিত্তিতে পরের বছর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তর গঠন করা হয়। একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে অধিদপ্তরের কাজ পরিচালিত হয়। আইনে প্রতিষ্ঠানে অভিযান, সিল করা, জব্দ ও আধা বিচারিক ক্ষমতা আছে। তারা অভিযোগ নিতে পারেন। আবার সরাসরি তারা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানও চালান। তাদের কাজের এলাকাও আইন দিয়ে নির্দিষ্ট করা আছে। আইনে অধিদপ্তর সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা জরিমান অথবা উভয় দণ্ড দিতে পারে। আর জরিমানার টাকার শতকরা ২৫ ভাগ  অভিযোগকারী পাবেন। তারা ক্ষতিপূরণ অথবা ভোক্তার সাথে বিক্রেতার চুক্তির শর্ত পালনে বাধ্যও করতে পারেন।

ভোক্তারা এখন জানতে শুরু করেছে: নাজের

ঢাকায় ভোক্তা অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে এবং দেশের বিভাগ ও জেলা কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন ভোক্তারা। অনলাইন  অথবা সরাসরি  কত দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে তার কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। তবে অভিযোগ করতে হয় ৩০ দিনের মধ্যে।

অভিযোগ ও নিস্পত্তি

২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভোক্তা অধিদপ্তর সারাদেশে মোট ৬০ হাজার ৬৫১টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে। নিস্পত্তি করেছে ৫৭ হাজার ৫৩৮টি। ধীরে হলেও  প্রতিবছর অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২০-২১ সালে মোট অভিযোগ ছিল ১৪ হাজার ৯১০টি। আর ২০২১-২২ সালের প্রথম ৯ মাসে অভিযোগ ১২ হাজার ৭৬৭টি।

আর ২০২১ সাল বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছে ৪৩ হজার ২০৯টি। দণ্ড দেয়া হয়েছে এক লাখ তিন  হাজার ৩৪৭টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে। বাজার অভিযানে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৭১ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার ৪৪২ টাকা। আর ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে মোট জরিমানা আদায় করা হয়েছে চার কোটি ৮৩ লাখ  ৭২ হাজার ৫০৮ টাকা। শতকরা ২৫ ভাগ হিসেবে অভিযোগকারীরা পেয়েছেন এক কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ১২৭ টাকা। এই অর্থ পেয়েছেন ছয় হাজার ৮৪৫ জন। 

২০২০-২১ সালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে  ২৮০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন। জরিমানা আদায় করেছে ১৮ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩০ টাকা। মোট মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হয় পাঁচ হাজার ৮৯৭টি।

পণ্যে ভেজাল, ওজনে কম, বেশি দাম নেয়া, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য, ক্রেতার সাথে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ, মজুতদারি-এই সব বিষয়েই ভোক্তা অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে ই-কমার্স, ব্যাংক ও অনলাইনে আর্থিক লেনদেন, টেলিকম ও স্বাস্থ্যখাতে ভোক্তা অধিদপ্তরের ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা নেই।

সমস্যা যেখানে

 ই-কমার্স, ব্যাংক ও অনলাইনে আর্থিক লেনদেন, টেলিকম ও স্বাস্থ্যখাতে ভোক্তা অধিদপপ্তরের ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা না খাকায় ভোক্তারা ওইসব ক্ষেত্রে ভোক্তারা প্রতিকার পাচ্ছেন না। এইসব খাতে এখন ভোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এস এম নাজের হোসেন বলেন, "কেউ যদি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করতে গিয়ে ক্ষতির শিকার হন, তাহলে এখানে প্রতিকার পান না। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন। আবার মেবাইল ফোনের গ্রাহকরা যদি সেবা ঠিকমতো না পান তার প্রতিকার পেতে যেতে হয় বিটিআরসিতে। ই-কমার্সে গ্রাহকদের অভিযোগ বাড়ছে, প্রতারণা বাড়ছে, কিন্তু ভোক্তা অধিদপ্তরের কিছু করার নেই। হাসপাতাল-ক্লিনিকে অভিযান চালাতে হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে।”

আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে: শফিকুজ্জামান

আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অধিদপ্তরকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা ও এক বছরের কারাদণ্ডের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ভোক্তারা যেভাবে ক্ষতির শিকার হন, তাতে এই দণ্ড পর্যাপ্ত নয়। বরং এই আইনটির সুযোগ দিয়ে কালোবাজারি, ভেজালকারী ও মজুতদাররা বেঁচে যান। বিশেষ ক্ষমতা আইনে ভেজাল ও মজুতের ব্যাপারে আরো বেশি শাস্তির বিধান আছে। ১৪ বছরের কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে ওই আইনে। নাজের হোসেন বলেন, "লা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকরা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ করেন। তারা কেউ কেউ সুবিধা দেয়ার জন্য এই আইনটি প্রয়োগ করেন।”

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এন শফিকুজ্জামান  বলেন, "আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখানে দণ্ড ও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো ছাড়াও ই-কমার্সকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আইনটি এখন মন্ত্রিপরিষদে আছে।”

তিনি বলেন, "আমরা তারপরও এখন চেষ্টা করছি আইনটি যত ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। আমরা আইনের মধ্যে থেকেই এখন হাসপাতাল-ক্লিনিকে অভিযান করছি।”

তিনি জানান, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা অধিদপ্তরের নেই। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এই আইন প্রয়োগ করতে পারেন।

এদিকে আইনে প্রত্যেক জেলায় ভোক্তা অধিকার পরিষদ থাকার কথা। জাতীয় পর্যায়ে থাকলেও জেলা পর্যায়ে নেই। এই পরিষদের কাজ হলো ভোক্তাদের সচেতন করা। ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে অভিযোগ দায়েরে সহায়তা করা।

জনবল সংকট

সারা দেশে ভোক্তা  অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ১০১ জন। আর অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারি আছেন ১৩৫ জন। এই জনবল দিয়ে সারা দেশের ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ সম্ভব নয়। আর এখন মানুষের আগ্রহ বাড়ায় অভিযোগের চাপ বাড়ছে। তারপরও এখন পর্যন্ত ৯০ ভাগ অভিযোগের নিস্পত্তি করা হয়েছে বলে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। কিন্তু নিয়মিত অভিযান পরিচালনা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মোট দুই হাজার ৩০৫ জন জনবলের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে থাকলেও তার অগ্রগতি নেই। এস এম নাজের হোসেন বলেন, "ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ এবং মানুষের আগ্রহ ধরে রাখতে হলে জনবল বাড়াতে হবে। নয়তো অভিযোগ নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগলে ভোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।”