‘সাকিব-মুস্তাফিজরা' কোথায়?
১১ এপ্রিল ২০১৬একবার ভাবুন তো, দীর্ঘ পথ পার হয়ে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠে গেল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা৷ সঙ্গে দক্ষিণ অ্যামেরিকা অঞ্চল থেকে উরুগুয়ে আর প্যারাগুয়েও৷ হঠাৎ করে ইকুয়েডর-কলম্বিয়া-পেরু বলে বসল, ‘আমরা ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলব৷' সমীকরণও এমন দাঁড়াল যে, এই ত্রিদেশীয় সিরিজে যে জিতবে, দক্ষিণ অ্যামেরিকা অঞ্চলের চতুর্থ দল হিসেবে বিশ্বকাপে চলে যাবে সে-ই৷ বাদ পড়বে আগের চার দলের কোনো একটি!
এ-ও কি কখনো হয়? সম্ভব? হয়ত ফুটবলে হয় না৷ কিন্তু ক্রিকেটে হয়! হচ্ছে বৈকি! ক্রিকেটের এখনকার ‘মাঠের বাইরের খেলাটি' বোঝাতে আমাদের একটু ‘টাইম মেশিনে' চেপে বসতে হবে৷ ভয় নেই, বেশি দূরে নয়, গন্তব্য ২০১৫ সালের জুন মাস৷
ভারতের বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগে জানা গেল, ভারত-বাংলাদেশ সিরিজে ছয় ওয়ানডের দু'টিতে জিতলেই নিশ্চিত বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা৷ আগামী ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে৷ ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটাও সেখানেই৷ এক অর্থে সেটি হবে বিশ্বকাপের মহড়া টুর্নামেন্ট৷ এমনিতে শীর্ষ আট দলের বড় টুর্নামেন্টে খেলার আগ্রহ তো আছেই, তাছাড়া ইংল্যান্ডের কন্ডিশনটাও পরখ করে দেখার সুযোগ৷ কে আর হাতছাড়া করতে চায়?
ভারতের বিপক্ষে প্রথম দু'টি ওয়ানডে জিতেই বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশ নেওয়া নিশ্চিত করে ফেলল৷ এই আনন্দের খবর টাটকা থাকতেই জানা গেল, নতুন সমীকরণ হাজির৷ কেন? ওদিকে পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে একেবারেই সূচির বাইরে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে যাচ্ছে! ঐ সিরিজের ফলাফল আবারও র্যাংকিংয়ে পরিবর্তন আনবে৷ অনিশ্চিত হয়ে যাবে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা!
পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ঝুলিয়ে রেখে জিম্বাবোয়ের সঙ্গে খেলল বাড়তি একটা হোম সিরিজ৷ তাতে জিতে যে-ই না র্যাংকিংয়ের আটে ওঠা নিশ্চিত হয়ে গেল, পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বলে দিল, ‘ভাই, ত্রিদেশীয় সিরিজ আমরা খেলতে পারছি না৷' কেন? মাত্রই আট নম্বরে উঠে আসা পাকিস্তান যে আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে নয়ে নেমে গেলে বাদ পড়বে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে!
সত্যি কথা বলতে, এ-ই হচ্ছে এখন৷ সমস্যার মূলে আছে হতচ্ছাড়া ব়্যাংকিং৷ বেচারা ব়্যাংকিং অবশ্য বলতে পারে, ‘আমি কী করলাম? আমার তো কিছু করার ক্ষমতাই নেই৷' সত্যিই তা-ই৷ সমস্যার মূলেরও মূলে আসলে আইসিসি৷ যারা ঠিক করে দিয়েছে, ব়্যাংকিংয়ের সেরা আটটি দল খেলবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আর বিশ্বকাপ৷ কিন্তু এই ব়্যাংকিং প্রভাবিত করছে যে ভবিষ্যৎসফর সূচি (এফটিপি-ফিউচার ট্যুরস প্রোগ্রাম), সেটা নিয়ন্ত্রণের ভার তাদের হাতেই নেই৷ এ যেন পাড়ার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিস্কুট দৌড় – যে যেভাবে পারে, সবার আগে ফিনিশিং লাইন যে ছোঁবে সে-ই ফার্স্ট!
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জায়গা পাওয়া নিয়ে পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ গত বছর যে নাটকটা করল, নিশ্চিত থাকুন, বিশ্বকাপের সময়টা ঘনিয়ে এলে আরও বড় নাটক হবে৷ ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে র্যাংকিংয়ের আট নম্বরের মধ্যে না থাকলে যে খেলতে হবে বাছাই পর্ব৷ আইসিসি-র নিয়মটাতেই তাই গলদ আছে৷ সেখানে ‘ফেয়ার প্লের' সুযোগ নেই৷ এটা এখন যে কোনো দল নিজ স্বার্থে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে৷ যে যার কূটনৈতিক ক্ষমতাবলে আয়োজন করবে সিরিজ৷
এ কারণেই ক্রিকেটে এখন বোর্ডগুলোর কূটনৈতিক ক্ষমতা আরও বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এমনিতেই এফটিপিতে বাংলাদেশ সৎ ছেলের অনাদর পেয়ে থাকে৷ গত জুনে যখন এ নিয়ে খুব হইচই হচ্ছিল, হিসেব কষে দেখিয়ে দিয়েছিলাম, বর্তমান এফটিপি অনুযায়ী, জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২৫টি ওয়ানডে খেলতে পারে, যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সর্বোচ্চ ৩৯টি আর পাকিস্তান সর্বোচ্চ পাকিস্তান ৫২টি ওয়ানডে খেলার সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে৷
সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছে না৷ ফেয়ার প্লে হওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ বলতে পারেন, বাংলাদেশও তো অনির্ধারিত বাড়তি সিরিজের আয়োজন করতে পারে৷ অবশ্যই পারে৷ কিন্তু এখানে আরও বেশি সমস্যা!
গত ১০ বছরে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৪৯টি ওয়ানডে খেলেছে জিম্বাবোয়ের সঙ্গে৷ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১টি ওয়ানডে খেলেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে৷ র্যাংকিংয়ের পদ্ধতিটা এমনই, নীচু সারির দলগুলোর বিপক্ষে জিতলে আপনি পয়েন্ট পাবেন খুব কম, হারলে হারাবেন অনেক বেশি৷ এ কারণে জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে খেলায় আমাদের লাভ নেই, বরং ক্ষতির আশঙ্কা আছে৷ আর বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি খেলে জিম্বাবোয়ের সঙ্গেই৷ কারণ বাকি দলগুলো যে সময় করে উঠতে পারে না বাংলাদেশ সময় দেওয়ার জন্য!
টেস্টে আরও করুণ অবস্থা৷ এক অ্যাশেজ সিরিজেই হয় পাঁচটি ম্যাচ৷ আর বাংলাদেশের জন্য সারা বছরের বরাদ্দ ৫-৬টি টেস্ট৷ ২০১২ সালে এমনও হয়েছে, ১২ মাসে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে দু'টি৷ অবশ্য ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে নতুন খসড়া এফটিপি করা হয়েছে, সেটিতে বাংলাদেশের টেস্ট খেলার সম্ভাবনা বাড়ছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত এটি দুই বোর্ডের সমঝোতার ওপর নির্ভর করছে৷
এ কারণেই ক্রিকেটীয় রাজনীতিতে আরও বেশি দর-কষাকষির ক্ষমতা অর্জন করা জরুরি৷ ক্রিকেটীয় কূটনীতিতে জরুরি আরও বেশি দক্ষতা৷ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-র কাছ থেকে যে ক্ষমতা বা দক্ষতার দেখা মেলেনি, অস্ট্রেলিয়া যখন পরপর জাতীয় দল ও তাঁদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল করল৷ সর্বশেষ তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন ইস্যুতেও তা-ই৷ ‘হ্যান কারেগাংতেই' সার, কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷ অথচ এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এই বাস্তবতা আরও বড় করে বোঝাল, ক্রিকেটে এগিয়ে যেতে হলে শুধু মাঠের খেলায় এগোলেই হবে না; মাঠের বাইরের ‘খেলাতেও' ঝানু, দক্ষ, অভিজ্ঞ খেলোয়াড় চাই৷
সত্যি বলতে, বাংলাদেশের ক্রিকেট এ পর্যন্ত আসার পেছনে বড় অবদান এই ক্রিকেটীয় কূটনীতির৷ না হলে মাত্র এক বছরের প্রথম শ্রেণির ঘরোয়া টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতা আর বড় আন্তর্জাতিক সাফল্য বলতে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো – এই দুই সম্বল করেই টেস্ট স্ট্যাটাস বাংলাদেশ পেত না৷
বাংলাদেশকে টেস্ট মর্যাদা এনে দিয়েছে তখনকার ক্রিকেটীয় কূটনীতির সাফল্যই৷ সেখান থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন অনেক এগিয়েছে৷ কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এর মধ্যে একজন বাংলাদেশি আইসিসি সভাপতি পাওয়ার তথ্য মাথায় রেখেই বলছি, ক্রিকেটীয় কূটনীতিতে আমরা পিছিয়ে পড়েছি৷ আমরা বিশ্বসেরা ক্রিকেটারদের তুলে এনেছি, সাকিব-মুস্তাফিজদের মতো৷ কিন্তু ক্রিকেট-কূটনীতির ‘সাকিব-মুস্তাফিজরা' কোথায়?
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷