মালামাল না নিয়েই বিল পরিশোধ
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১২০১৪ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ মুগদা জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে৷ গত অর্থবছরেও কেনাকাটা নিয়ে অডিটে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে বিস্তর আপত্তি ওঠে৷ ১৬৯ টাকার বিছানার চাদর ৬০৩ টাকায়, ৪৭২ টাকার কম্বল দুই হাজার ৪১৮ টাকায়, ২১০ টাকার পর্দা ১২০০ টাকায়, ২২২ টাকার সার্জন গাউন ৬০৩ টাকায় কিনেছে হাসপাতালটি৷ এমনকি লিলেন সামগ্রী কেনার দুইটি বিলে বাজার দরের চেয়ে প্রায় এক কোটি টাকা বেশি খরচ করেছে হাসপাতালটি৷ এমন চিত্র আছে কেমিক্যাল রি-এজেন্ট সামগ্রী, আসবাবপত্র বা ঔষধ কেনাকাটাতেও৷ এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন সময়ে জিনিসপত্র কেনাকাটার হিসাবেও রয়েছে বিস্তর গড়মিল৷
২০১৯ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরে বিপুল পরিমাণ এক্স-রে ফিল্মের ক্রয় দেখিয়ে বিল পরিশোধ করে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল৷ অথচ ভাণ্ডারে সেগুলোর যথাযথ হিসাব পাওয়া যায়নি৷ হিসাব না পাওয়া এমন পণ্যের দাম ছিল পাঁচ লাখ ৫২ হাজার টাকা৷ এছাড়াও ২০২০ সালে কেনাকাটার হিসাবে কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে ১৫৫০ পিস হেপেরিন ইনজেকশন, ১৫০৪ টি ব্লাড লাইন ও কিছু সার্জিক্যাল পণ্যের হিসাব মেলেনি৷ পরিশোধিত বিল অনুযায়ী ৬৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকার মালামালের হদিস মেলেনি৷
এছাড়াও হাসপাতালটির প্যাথোলজি বিভাগে এক কোটি ৭২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের ডেঙ্গু ডিভাইস, কেথ্রিইডিটিএ টিউব ও ২৯ টি কেমিক্যাল রিএজেন্টের যথাযথ হিসাব নেই৷ ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটি এক কোটি ৮৬ লাখ টাকা খরচ করে বিভিন্ন কেমিক্যাল রি-এজেন্ট (রাসায়নিক উপকরণ) সামগ্রী কেনাকাটায়৷ এই বিলের মধ্যে ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা ছিল রক্তের নমুনা সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত কেথ্রিইডিটিএ টিউব-র জন্য৷ বিলের বিপরীতে পাঁচ মে সেসব পণ্য সরবরাহ করার কথা উল্লেখ রয়েছে৷ কার্যাদেশ অনুযায়ী, প্রতি বাক্সে এক হাজার করে মোট ২৫ বাক্স টিউব থাকার কথা৷ কিন্তু হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে সেগুলো প্রাপ্তির কোনো হিসাব নেই৷ এমনকি হাসপাতালের যে ইউনিটের জন্য কেনা হয়েছে সেই প্যাথোলজি বিভাগও সেগুলো বুঝে পায়নি৷ ফলে মালামাল গ্রহণ না করেই এই বাবদ ঠিকাদারকে সোয়া ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করেছে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল৷ এইসব বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অডিটে যথাযথ জবাব দিতে পারেনি৷
২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন সাতজন৷ গত ১৭ জানুয়ারি যোগ দিয়েছে ডা. অসীম কুমার নাথ৷ যোগাযোগ করা হলে তিনি পূর্বের অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি৷
শুধু মুগদা নয়, মালামাল সরবরাহ না করা সত্ত্বেও বিল পরিশোধের অভিযোগ এসেছে ঢাকার আরো কয়েকটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে৷ যেমন, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল৷ ২০২০ সালের ৯ মে ও ২১ জুন, দুটি আলাদা বিলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ক্লিয়ার এজ টেকনোলজিকে এক কোটি ৬৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা পরিশোধ করে হাসপাতালটি৷ প্রথম বিলটিতে ৮৭৫টি ক্লেক্সেন ৬০ এমজি ইনজেকশনের কার্যাদেশ ছিল৷ যারমধ্যে হাসপাতাল ৫০৫টি বুঝে পেয়েছে৷ ৩৭০টি ঔষধ না পেলেও ৭৬৫ টাকা করে সেগুলোর জন্যেও দুই লাখ ৮৩ হাজার টাকা ঠিকাদারকে দেয়া হয়েছে৷
২১ মে আরেকটি বিলে পরিশোধ করা হয়েছে ৬৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা৷ এর মধ্যে আট লাখ ১০ হাজার টাকা ছিল ৫০০টি সোলুপ্রেড ইনজেকশনের জন্য৷ অথচ এর একটি ঔষধও হাসাপাতালকে দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি৷ সব মিলিয়ে দুইটি বিলে মোট ১০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল কোনো মালামাল ছাড়াই৷ হাসপাতালটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আপত্তির জবাবে বলেছিল, সরবরাহকারীর কাছ থেকে মালামাল বুঝে নেয়া হয়েছিল৷ তার ভিত্তিতেই কর্তৃপক্ষ বিল পরিশোধ করেছে৷ কী কারণে মজুদে তা কম দেখানো হয়েছে সেটি পরবর্তীতে তারা যাচাই করবে৷ যদিও এই বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন মালামাল বুঝে না পাওয়ায় তারা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছেন৷ ‘‘যেসব মালামাল দেয়া হয়নি, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে সেগুলো দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে এবং তারা দেবে৷ তাদেরকে ডাকা হয়েছে৷ তারা বলেছে এটা পূরণ করে দেবে,’’ বলেন ডা. সেহাব উদ্দিন৷
মালামাল না নিয়েই ঠিকাদারকে টাকা পরিশোধের ঘটনা আছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেও৷ ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৫৬ ধরনের কেমিক্যাল রি-এজেন্ট সামগ্রী সরবরাহে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেয় তারা৷ এর বিপরীতে ২০২০ সাল পর্যন্ত কোনো মালামাল নেয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে৷ অথচ মূল্য বাবদ দুই কোটি ৯৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা ঠিকই পরিশোধ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷
২০২০ সালের ৩০ মে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল একই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৫,২৭৭টি ডেঙ্গু ডিভাইস সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়৷ প্রতিটির দাম ৩৭৯ টাকা হিসাবে মোট বিলের অঙ্ক ছিল ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৩ টাকা৷ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সর্বসাকুল্যে ডিভাইস সরবরাহ করেছে ১০০ টি, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাকি ৫১৭৭টিসহ পুরো টাকাই পরিশোধ করেছে৷ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল গত অর্থবছরে মোট তিন কোটি ১৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয় করেছে, যার বিপরীতে কোনো মালামাল গ্রহণ করেনি৷ যদিও হাসপাতালটি বলছে, কার্যাদেশ অনুযায়ী প্রতিটি পণ্যই তারা বুঝে নেবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে৷ ডয়চে ভেলেকে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ বলেন, ‘‘আমি যদি প্রথম দিনই সমস্ত কিছু একসাথে নিয়ে নিতাম, তাহলে দেখা যেতো জুনের মধ্যেই (জিনিসপত্রের) মেয়াদ শেষ হয়ে যেতো৷ জুলাই-আগস্টে আমার চলার মতো কিছু থাকতো না৷ এমন না যে একটা আইটেমও কাউকে ছাড় দেয়া হয়েছে৷ ...মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যেই পুরোটা সংগ্রহ করে নেবো৷ এক পয়সাও তাদের হাতে থাকবে না৷’’ ২০১৯ সালের কার্যাদেশের রি-এজেন্ট সামগ্রীগুলো কেন এখনো নেয়া হয়নি সেই বিষয়ে তিনি বলেন. ‘‘রিএজেন্ট সামগ্রী আমরা একসাথে নেই না৷ ধাপে ধাপে নেই৷ এতে ওদের (ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান) কোনো লাভ নেই. আমাদের সুবিধার জন্যই এটা করি৷ বরং একবারে সরবরাহ করলে তার খরচ কম হতো৷ আমরা তিনমাস পরপর তাদের কাছ থেকে ধাপে ধাপে নেই৷ ওরা একবারেই দিতে ইন্টারেস্টেড থাকে৷ আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, একটা আইটেম, একটা টাকাও তারা পেন্ডিং রেখে যেতে পারবে না৷ আমার যেটা আছে অর্ডার, সেটা শতভাগই তাকে দিয়ে যেতে হবে৷’’ কিন্তু সরবরাহকারীর কাছ থেকে মালামাল বা ঔষধ গ্রহণ না করে বিল পরিশোধের সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে৷
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহ করেনি, কিন্তু বিল পরিশোধ করে ইন্সটলেশন দেখানো হয়েছে এমন ঘটনাও আছে৷ যেমন, গত বছরের ৩০ জুনের মধ্যে চারটি এক্স-রে মেশিন সরবরাহে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুই কোটি ৮০ লাখ টাকার চুক্তি করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান৷ ২৮ জুনই প্রতিষ্ঠানটিকে বিল পরিশোধ করা হয়৷ কাগজপত্রে ২৯ তারিখে সেগুলোর ইন্সটলেশন রিপোর্টও (চালু হয়েছে এমন প্রতিবেদন) দেয়া হয়৷ অথচ যশোরে বেনাপোলের কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ যন্ত্রগুলো পরীক্ষাই করেছে তিন আগস্ট৷ নিয়ম অনুযায়ী, বিলম্বের জন্য ২৮ লাখ টাকার জরিমানা আদায় না করে উলটো বুঝে পাওয়ার আগেই পুরো টাকা দিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷ মালামাল সরবরাহের আগেই বিল পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের ডা. মোঃ আব্দুল গণি মোল্ল্যাহর কাছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সেসময় আমি অসুস্থ ছিলাম৷ তাই বিস্তারিত বলতে পারবো না৷ তবে এখানে এমন কিছু ঘটেনি তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি৷’’ অবশ্য নিরীক্ষা আপত্তির জবাবে হাসপাতালটি করোনা পরিস্থিতির অজুহাত দিয়েছিল৷
হাসপাতালে কেনাকাটায় এমনসব অনিয়মের উদাহরণ এবারই প্রথম নয়৷ মালামাল না নিয়েই হাসপাতালগুলোর বিল পরিশোধ নিয়ে বিভিন্ন সময়েই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হচ্ছে৷ তদন্তেও অনেক হাসপাতালে কোটি কোটি টাকা অর্থ লোপাটের ঘটনা উঠে এসেছে৷ তারপরও এই প্রবণতা বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ক্রয়ের দায়িত্বে যারা আছেন এবং যারা সরবরাহ করেন দুই দিকেই যোগাসাজশ থাকে৷ ‘‘একজন ইন্সপেক্টর থাকেন যিনি মালামাল সংগ্রহ করেন৷ তিনি রিসিভ না করেই হয়তো বলে দিচ্ছেন রিসিভ করে দিচ্ছি৷ সেটা আর কেউ দেখার নেই৷ তিনি যদি বলেন রিসিভ করে দিয়েছি তাহলে বিলটা পে হয়ে যাবে৷ এক্ষেত্রে যারা দেয় আর যারা গ্রহণ করে দুই পক্ষেরই যোগসাজশ আছে,’’ বলেন ডা. ইসলাম৷