মেয়েদের পায়ে পায়ে ‘সাইকেল-বিপ্লব’, বিশ্বে সমাদৃত বাংলাদেশ
২১ অক্টোবর ২০২২শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন ছোটখাটো এক ‘বাইসাইকেল বিপ্লব’ ঘটে গেছে৷ শুধু স্কুল-কলেজ নয়, চাকরিস্থলে যেতেও ইদানিং অনেকেরই পছন্দ বাইসাইকেল৷ ফলে দেশের বাজারে বাইসাইকেলের চাহিদা অনেক বেড়েছে৷ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা৷
লালমনিরহাটের ফুলগাছ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা আক্তার জানালেন, তার স্কুলের অধিকাংশ মেয়েই এখন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে৷ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার অনুভুতি জানাতে গিয়ে ডয়চে ভেলেতে ফারজানা বলেন, ‘‘আগে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম৷ অনেকদিনই পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেতো৷ পা ব্যাথা করতো, এতে রাতে পড়তে সমস্যা হতো৷ এখন স্কুলে যেতে আর দেরি হয় না৷ কষ্টও কম হয়৷’’ ক্লাস ফোর থেকেই বাইসাইকেল চালানো জানলেও সিক্সে উঠার পর বাবা তাকে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছেন৷ এখন সব বান্ধবী মিলে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যান ফারজানারা৷
লালমনিরহাটের ফুলগাছ উচ্চ বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী অনন্যা রায়ও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যান৷ এলাকার অধিকাংশ ছাত্রী সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসায় রাস্তায় তেমন কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না৷ মাঝে মধ্যে কিছু মোটরসাইকেল চালকের কারণে খানিকটা সমস্যা হলেও এমনিতে এলাকার সবাই তাদের এই সাইকেল চালানোকে ভালো চোখেই দেখছেন বলেই ডয়চে ভেলেকে জানান অনন্যা৷
শুধু লালমনিরহাট নয়, এই চিত্র এখন উত্তরের প্রায় সবগুলো জেলার৷ বিশেষ করে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে৷ যশোরের মনিরামপুরের উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহজাহান আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু উত্তর কেন, দক্ষিণের জেলাগুলোতেও কিশোরীরা এখন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসছে৷ আমার স্কুলে তো ৯০ শতাংশ মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে৷ আশপাশের এলাকাগুলোর চিত্রও একই রকম৷’’
ছাত্রীদের ঝরে পড়া ঠেকাচ্ছে সাইকেল
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগের দশকে উত্তরে শিক্ষায় বিল্পব ঘটে গেছে৷ তবে ঝরে পড়া ঠেকানো যাচ্ছিল না৷ বাইসাইকেল ঝরে পড়ার হার কমিয়ে দিয়েছে৷ কারণ, এই শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের দূরত্ব একটু বেশি৷ ভ্যানে করে যেতে প্রতিদিন তাদের ৪০-৫০ টাকা খরচ করতে হতো৷ এই টাকা অনেকের পরিবারের পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিল না৷ খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোর উপার্জন খুব বেশি ছিল না৷ তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে গরিব কিন্তু মেধাবী ছাত্রীদের সাইকেল দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ আমি নিজেই গত দুই বছরে সাড়ে ৩শ’ ছাত্রীকে সরকারি উদ্যোগে সাইকেল দিয়েছি৷ অনেকের পরিবার কিনেও দিয়েছে৷ এতে স্কুলে উপস্থিতি অনেক বেড়েছে৷ আগে যেখানে সপ্তাহে দুই-তিন দিন তারা স্কুলে যেতো এখন একদিনও মিস করে না৷ এতে তাদের রেজাল্টও ভালো হচ্ছে৷ ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাসের হার এখন বেড়েছে৷’’
ঠাকুরগাঁওয়ের গিলাবাড়ী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আফরফুন নেছা৷ তার বাবা রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই৷ তারাও এখন শিক্ষায় এগিয়ে গেছে৷ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসা করছে৷ এতে তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে না৷ পাশাপাশি বখাটেদের উৎপাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছে৷ স্কুলে যেতেও তাদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে৷ পাশাপাশি মনোযোগ বেড়েছে লেখাপড়ায়৷’’
বাইসাইকেল এখন দেশি ব্র্যান্ড
দেশে চাহিদা বাড়ায় মেঘনা গ্রুপ স্থানীয় বাজারের জন্য সাইকেল নিয়ে আসে ২০১১ সালে৷ প্রতিষ্ঠানটি ভেলোস ব্র্যান্ডের সাইকেল বিক্রি করছে৷ এজন্য ‘সাইকেল লাইফ’ ও ‘সাইকেল লাইফ এক্সকুসিভ’ নামে আলাদা বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে৷ সর্বনিম্ন ১২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত দামের সাইকেল রয়েছে তাদের৷
প্রাণ আরএফএল ২০১৪ সালে সাইকেল উৎপাদনে বিনিয়োগ শুরু করে৷ দেশের বাজারের বড় অংশ আমদানিনির্ভর হওয়ায় সম্ভাবনার বিবেচনায় দুরন্ত ব্র্যান্ডের সাইকেল উৎপাদন শুরু করে তারা৷ অল্প সময়ে ব্যাপক সাড়াও পায়৷
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রতি বছর দেশের বাজারে আমরা সাড়ে তিন থেকে ৪ লাখ বাইসাইকেল সরবরাহ করছি৷ এছাড়া আমরা বিদেশে রপ্তানি করছি প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ বাইসাইকেল৷ বিশেষ করে মফস্বলে বাইসাইকেলের চাহিদা দ্রুত গতিতে বাড়ছে৷’’
বাংলাদেশ বাইসাইকেল মার্চেন্টস অ্যাসেম্বলিং অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিবিএমএআইএ)-এর সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম জাহিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বংশালে দুই শতাধিক বাইসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ সারাদেশে সাড়ে চার হাজার খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ আগে বিদেশ থেকে আমদানি করে আমরাই সারাদেশে সাইকেল সরবরাহ করতাম৷ এখন দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরুর পর আমাদের গুরুত্ব কমেছে৷ তারাই সারাদেশে সাইকেল সরবরাহ করছে৷ ফলে আমরা এখন স্থানীয় বিক্রেতায় পরিণত হয়েছি৷’’
ইউরোপে রপ্তানি, ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ
মেঘনা ও আরএফএল ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিটা ও করভো নামের প্রতিষ্ঠানের ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে রপ্তানিমুখী সাইকেল তৈরির কারখানা করেছে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের বছরে মোট রপ্তানির পরিমাণ ১০ লাখের বেশি৷ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে শুধু বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার৷
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলছিলেন, আরএফএল রপ্তানি শুরু করে ২০১৫ সালে৷ বর্তমানে ১০ দেশে যাচ্ছে তাদের সাইকেল৷ বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের সাইকেলের চাহিদা বেশ ভালো৷
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, এ বছরেই বিশ্ববাজারে সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে পৌঁছাবে৷ তবে ইউরোপের বাজারে এখন রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে৷ ২০০৯ সালে ইউরোপে নবম স্থানে থাকলেও পরের বছর পঞ্চম স্থানে উঠে আসে৷ এবছর আরো এগিয়ে ইউরোপে সাইকেল রপ্তানিতে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ৷
আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশের বাজারে আমরা বিপণন করি না৷ ইউরোপে রপ্তানি করি৷ বর্তমানে বছরে দেড় লাখ সাইকেল আমরা রপ্তানি করছি৷ তবে কিছু সংকট আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে৷ কিছুদিন আগেও শিপমেন্ট খরচ ছিল দুই হাজার ডলার, এখন সেটা হয়েছে ১৫ হাজার ডলার৷ কস্টিং বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে৷ আবার সঠিক সময়ে পাঠানোর জন্য কন্টেইনার পাওয়া যাচ্ছে না৷ এতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে বাইসাইকেল রপ্তানি৷’’
বাইসাইকেল উৎপাদনের শুরুর গল্প
বাংলাদেশে প্রথম বাইসাইকেলের কারখানা করে আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড৷ ১৯৯০ সালে যখন মালয়েশিয়ায় দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছিল তখন সেখানে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়৷ কারখানায় দক্ষ জনবলের প্রয়োজন৷ অনেক বাংলাদেশি কাজ করতো সেখানে৷ তখন সেখানে ইয়া চ্যাং মিন নামে একজন তাইওয়ানি একটি সাইকেল তৈরির কারখানা চালাতেন৷ সেখানে কাজ করতেন কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিক৷ ইয়া চ্যাং-এর কারখানাটিও তখন শ্রমিক সংকটে পড়েছিল৷ তিনি তার বাংলাদেশি কর্মীদের সাথে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন৷ তখন তারা বাংলাদেশে তার কারখানাটি স্থানান্তর করার পরামর্শ দেন, কারণ, বাংলাদেশে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়৷ এভাবেই বাংলাদেশে বাইসাইকেল উৎপাদন শিল্পের সূচনা হয়৷
১৯৯৪ সালে মালয়েশিয়ার বাইসাইকেল প্রস্তুতকারক কোম্পানি আলিটা দেশে একটি কারখানা স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিবন্ধন লাভ করে৷ ১৯৯৫ সালের মার্চে নতুন কোম্পানি আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড উৎপাদন শুরু করে৷ কোম্পানিটি দেড় বছরের মধ্যেই ইউরোপে রপ্তানি শুরু করে৷ ফলে বিশ্ব বাজারে ধীরে ধীরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সাইকেলের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়৷
আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রাথমিকভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল প্রমাণ করা যে সাইকেলগুলো বাংলাদেশেই তৈরি৷ আমাদের সাইকেলের গুণমানও প্রমাণ করতে হয়েছিল৷ ১৯৯৭ সাল থেকে রপ্তানি অনেক মসৃণ হয়েছে৷ ২০০৮ সাল থেকে সাইকেল রপ্তানি লাভজনক হতে শুরু করে৷’’