1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যেমন আছে, যেভাবে চলছে খারিজি মাদ্রাসা

২৬ এপ্রিল ২০১৭

পশ্চিমবঙ্গে তিন ধরনের মাদ্রাসার মধ্যে খারিজি মাদ্রাসার সংখ্যা ৫-৬ হাজারের মতো৷ সরকারি অনুমোদনহীন এসব মাদ্রাসা চলে মূলত দানের টাকায়৷ বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার মতো পশ্চিমবঙ্গের এ ধরনের মাদ্রাসা নিয়েও আছে বিতর্ক৷

https://p.dw.com/p/2bixU
ছবি: DW/P. Samanta

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সংখ্যালঘু গরিব মুসলিম পরিবারের ছেলে-মেয়েদের জন্য বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করে চলেছে এই মাদ্রাসা৷ তবে খারিজি মাদ্রাসার হাল-হকিকত তুলে ধরার আগে পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ছবিটা হাজির করা দরকার৷

এই রাজ্যে মূলত তিন ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে৷ এক, সরকারি অনুমোদন ও আর্থিক অনুদান প্রাপ্ত৷ দুই, সরকারের স্বীকৃতি পেলেও অনুদান থেকে বঞ্চিত এবং তিন, সরকারি অনুমোদন নেই ও অনুদান পায় না এমন মাদ্রাসা৷ তৃতীয় ধারাটিই খারিজি বা নিজামিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচিত৷

পশ্চিমবঙ্গে প্রথম শ্রেণির মাদ্রাসাগুলি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থারই অংশ৷ সরকারি অনুমোদন ও অনুদান দুই-ই পায় এমন মাদ্রাসার সংখ্যা ৬১৪৷ এর মধ্যে ‘হাই মাদ্রাসা' ৫১২টি, সিনিয়র মাদ্রাসা ১০২টি৷ আবার হাই মাদ্রাসার মধ্যে ৪০০টি হাই মাদ্রাসা আর ১২টি জুনিয়র হাই মাদ্রাসা৷ এ সব হাই মাদ্রাসা পরিচালনা করে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড৷ অন্যান্য মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে বাড়তি ইসলাম ধর্ম ও আরবি ভাষা শিক্ষার সুযোগ এখানে আছে৷ তবে হাই মাদ্রাসায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ইসলামিক শিক্ষার সুযোগ নেই, কারণ, এই পর্যায়টি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ পরিচালনা করে৷ ২১০টি হাই মাদ্রাসা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়েছে৷

সিনিয়র মাদ্রাসায় মাধ্যমিক (আলিম) ও উচ্চমাধ্যমিক (ফাজিল) স্তরে ইসলামিক শিক্ষার পরিসর বেশি৷ ৬৬টি সিনিয়র মাদ্রাসাকে ফাজিল স্তরে উন্নীত করা হয়েছে৷ এই দ্বিতীয় প্রকার মাদ্রাসার সংখ্যা ২৩৫টি৷ এগুলি মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের অধীন, সরকারি অনুমোদন রয়েছে, কিন্তু শিক্ষকরা সরকারি স্কুলের মতো বেতন পান না,অর্থাৎ, সামান্য বেতনে তাঁদের পড়াতে হয়৷ এছাড়া, মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের অধীন রয়েছে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ও মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্র৷

পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের হিসেব অনুযায়ী, অনুমোদিত ৬১৪টি মাদ্রাসার মধ্যে ৫৫৪টি কো-এড, অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে একসঙ্গেই পড়ে সেখানে৷ ৫৭টি শুধু মেয়েদের জন্য, তিনটি ছেলেদের জন্য৷ ১৭টি মাদ্রাসা উর্দু মাধ্যমের৷ অনুমোদিত মাদ্রাসার মধ্যে ১৮৩টিতে বৃত্তিমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়৷

কলকাতায় সরকার স্বীকৃত ও অনুদান প্রাপ্ত মাদ্রাসা ৯টি৷ এর মধ্যে ৮টি হাই মাদ্রাসা, একটি সিনিয়র মাদ্রাসা৷

এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের খারিজি মাদ্রাসা৷ এইমাদ্রাসাগুলি ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্ক হয়েছে, সরগরম হয়েছে রাজনীতি৷ কিন্তু রাজ্যের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের আর তাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এই মাদ্রাসাগুলির উপযোগিতা অনস্বীকার্য৷

খারিজি মাদ্রাসা প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার একটা মডেল৷ পশ্চিমবঙ্গে এই মাদ্রাসা অসংগঠিত, একটির সঙ্গে অপরটির যোগসূত্র নেই৷ এগুলি স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়৷ সরকারি অনুদান যেহেতু নেই, সেই কারণে এগুলির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণও নেই৷ তাই রাজ্যে খারিজি মাদ্রাসার মোট সংখ্যা কত, সেটাও নির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল৷ মোটের উপর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আনুমানিক ৫-৬ হাজার খারিজি মাদ্রাসা রয়েছে৷ কেন্দ্রীয় বোর্ড বা পরিচালন পর্ষদ না থাকায় মাদ্রাসা বা শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা কত, তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না৷

বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন ফোরামের সভাপতি ইসারুল মণ্ডল জানান, এই মাদ্রাসাগুলি সম্পর্কে সরকারের কাছেও নির্দিষ্ট তথ্য নেই৷ মুসলিমদের জাকাত বা দানের টাকায় এই প্রতিষ্ঠানগুলি চলে৷ এখানে মূলত ধর্মীয় শিক্ষাই দেওয়া হয়৷ এই বিদ্যালয়গুলির উপর নির্ভর করে দরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলি৷ এই অভিভাবকদের কাছে বিদ্যালয় বা মাদ্রাসার শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ মসজিদ লাগোয়া ছোট ঘরে যে পঠনপাঠন চলে, তার উপরই ভরসা রাখে গরিব মুসলিম পরিবার৷

Clip_Sattar2 - MP3-Stereo

কোনো প্রত্যন্ত গ্রাম, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি, সেখানে ধর্মাশ্রিত এই ব্যবস্থার আজও কোনো বিকল্প নেই৷ তার উপর বড় সুবিধা অন্নসংস্থানের৷ যে গরিব অভিভাবক অতি কষ্টে দু'মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করেন, তাঁর ছেলে-মেয়ে আবাসিক খারিজি মাদ্রাসায় গিয়ে পড়াশোনার সঙ্গে পেট ভরে খেতে পেলে সেটা বাড়তি প্রাপ্তি৷ অনেক অভিভাবক প্রজন্ম পরম্পরায় এই শিক্ষাব্যবস্থার শরিক৷ তাই নতুন প্রজন্মকেও পূর্বসূরিরা খারিজি মাদ্রাসায় পাঠাতে পছন্দ করেন৷ আবার অনেকে সচেতনভাবেই চান, তাঁর সন্তান হাফেজ, মৌলানা, ইমাম বা মোয়াজ্জেম হয়ে উঠুক; পরম্পরায় বহমান ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকুক৷

এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সংখ্যালঘু-মানসে সমষ্টি চেতনা৷ সব দেশেই সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এটা সত্যি৷ তাই ধর্মাশ্রিত শিক্ষার প্রতি ঝোঁক ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যমান৷

কী ধরনের পড়াশোনা হয় খারিজি মাদ্রাসায়? মুর্শিদাবাদের ফারাক্কার খারেজি মাদ্রাসা আল জামিয়াতুত তাবলিমিয়া নাজমুল হুদা আমতলা মাদ্রাসার নাজেম তথা ব্যবস্থাপক আব্দুল মান্নান জানান, কোরান-হাদিসের ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে আরবি ভাষার পাঠ দেওয়া হয়৷ আরবি সাহিত্য পড়ানো হয় এই আবাসিক মাদ্রাসায়৷ এক দশক আগেও শুধু ধর্মশাস্ত্র পাঠের উপর জোর দেওয়া হতো৷ এখন পরিস্থিতি বদলেছে, বর্তমানে এসব মাদ্রাসায় বাংলা, ইংরেজি, গণিতও শেখানো হয়৷ এখানকার সব পড়ুয়া যেহেতু বাঙালি মুসলিম পরিবারের ছেলে-মেয়ে, তাই তাদের মাতৃভাষার পাঠ দেওয়া জরুরি৷ এছাড়া বিশ্বায়নের পর ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে৷ যাতে খারিজি মাদ্রাসার পড়ুয়ারা অন্যান্য মাদ্রাসা বা বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে ভবিষ্যতে পিছিয়ে না পড়ে, সে জন্য তাদের ইংরেজি শেখানো হয়৷ এর সঙ্গে উর্দু শেখারও ব্যবস্থা আছে৷

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘বছরে দু'বার পরীক্ষা নেওয়া হয়৷ অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা৷ প্রথমটি রবিউলে, পরেরটি শাওয়াল মাসে৷ ১০০ নম্বর করে প্রতি বিষয়ে মোট ৭০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হয়৷ ৬০০-র বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে আমতলা মাদ্রাসায়৷ ১৫ জন শিক্ষক ও চারজন শিক্ষিকা রয়েছেন৷ এ মাদ্রাসায় ভারতের জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না৷ উর্দুতে প্রার্থনা সংগীত হয়৷''

এখান থেকে পাশ করার পর ছাত্ররা ইসলামি ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেয়৷ হাফেজ, ইমাম, মোয়াজ্জেম, মৌলানা, ক্কারি প্রভৃতি পরিচয় বা স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এগুলির কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই৷ উচ্চশিক্ষা বা চাকরির সিংহভাগ ক্ষেত্রে খারেজি মাদ্রাসার ডিগ্রির মূল্য নেই৷ তাই ভারতের মাদ্রাসানির্ভর মুসলিম সমাজের নিজস্ব শিক্ষা পরিকাঠামোর সঙ্গে এখানকার পড়ুয়ারা ভবিষ্যতে অঙ্গীভূত হয়ে যায়, সেটাই তাদের জীবিকা হয়ে ওঠে৷

অবশ্য সরকার যা-ই করুক, ভারতীয় সংবিধান সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র চালানোর অধিকার দিয়েছে৷ তাই খারিজি মাদ্রাসা কোনো সরকার দ্বারা স্বীকৃত না হলেও তার বৈধতা নিয়ে আইনি প্রশ্ন তোলা দুরূহ৷

আব্দুল মান্নান জানান, খারিজি মাদ্রাসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দানেই চলে৷ সরকারি অর্থসাহায্য মেলে না৷ এখানকার ছেলে-মেয়েরা সরকারি প্রকল্প মিড-ডে মিলও পায় না৷ পশ্চিমবঙ্গের খারিজি বা কওমি মাদ্রাসা সরকার অনুমোদিত বা অনুদানপ্রাপ্ত নয়, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সেই দান গ্রহণে ইচ্ছুক নয়৷ সেক্ষেত্রে সরকার মাদ্রাসাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, যেমন হাই মাদ্রাসার ক্ষেত্রে হয়েছে৷

উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে দেওবন্দ মাদ্রাসা দেশের অগ্রণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ তারাও সরকারি সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছে৷ মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবিসহ কয়েকজন মুসলিম বিদ্বজ্জন ১৮৬৬ সালে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই দেওবন্দ বা ফুরফুরা, আহলে হাদিসের অধীনে যে খারিজি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়, সেগুলির শিক্ষার পরিবেশ কিছুটা ভালো হলেও পরিকাঠামোয় অনেকটা পিছিয়ে৷

পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুস সাত্তারের বক্তব্য, খারিজি মাদ্রাসার পড়ুয়ারা মসজিদ লাগোয়া ঘরে ইসলামিক শিক্ষা নিয়ে আবার প্রাথমিক স্কুলেও পড়তে যায়৷ সেখানে সে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানও পড়ে৷ তাঁর দাবি, এ রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই আধুনিক৷ তাই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা পরিদর্শনে এসেছিলেন৷ তাঁরা এখানকার পরিকাঠামোর প্রশংসাও করেছেন৷ সাত্তার বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন এতই উন্নত যে রাজ্যের এমন অনেক মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে মুসলিমদের তুলনায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের পড়ুয়া বেশি৷''

খারিজি মাদ্রাসা বারবার দেশবিরোধী কাজকর্মের অভিযোগে বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে৷ বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রে সামনে এসেছে শিমুলিয়া মাদ্রাসার কাজকর্ম৷ অধ্যাপক ও প্রাক্তন মন্ত্রী সাত্তার এই অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে বলেন, ‘‘ওটা আদৌ মাদ্রাসা ছিল কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ কবে থেকে চালু হলো, ওখানে কারা পড়ত, এসব নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে৷ আমার মনে হয়, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মাদ্রাসার নামে ওটা খোলা হয়েছিল৷ এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষার ঐতিহ্য আজও অম্লান৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য