রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কি ফিরতে পারবেন মিয়ানমারে?
২০ জুন ২০২১‘‘আমরা সব সময়ই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি৷ যখন সুযোগ হবে তখনই ফিরে যাব৷ কিন্তু তার আগে আমাদের সেখানে নিরাপত্তা, বাসস্থান, নাগরিকত্ব এবং ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে,'' বলেন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী কমিউিনিটির সহ-সভাপতি মাস্টার আব্দুর রহিম৷ এই নিশ্চয়তা কে দেবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সেটার নিশ্চয়তা মিয়ানমার সরকারকে দিতে হবে৷ কিন্তু নতুন সামরিক জান্তা সেটা করবে বলে মনে হয় না৷ উপরন্তু সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর আরো নির্যাতন বাড়ছে৷ তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো চাপ সৃষ্টি করতে হবে৷ জাতিসংঘের উদ্যোগ যথেষ্ঠ নয়৷’’
বাংলাদেশের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জনিয়ে বলেন, ‘‘আমরা ক্যাম্পে ভালো আছি৷ কিন্তু এখানে আমাদের দেয়ালবন্দি কাঁটাতারের মধ্যে জীবন৷ বাইরে চলাচলের অনুমতি নেই৷ বছরের পর বছর ধরে একটি জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে যাদের সামনে কোনো ভবিষ্যত নাই৷’’
ঠিক এমন এক বাস্তবতায় আজ (রোববার) বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস৷ জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে বর্তমানে আট কোটি বেশি শরণার্থী বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে রয়েছেন৷ যেখানেই তারা থাকুন না কেন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খেলাধুলার মতো বিষয়গুলোতে যাতে তারা অন্তর্ভুক্ত থাকেন সেই আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷ বাংলাদেশেও রোহিঙ্গারা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ কুতুপালং ক্যাম্পের মুখপাত্র ইউনূস আরমান বলেন, ‘‘এখানে আমরা ভালো আছি৷ তবে আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চাই৷ অনেক রোহিঙ্গা আছেন যাদের জন্ম এখানে৷ তারপরও তারা পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন না৷’’
শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের কুতুপালং এখন বিশ্বে সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে৷ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আট লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন সেখানে৷
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ভাসানচরসহ কক্সবাজারের ৩৫টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস৷ তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বয়সই ১৮ বছরের নিচে৷ আর এই ১১ লাখের মধ্যে সাত লাখ মিয়ানমার থেকে আসেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা ও নির্যাতনের মুখে৷
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার চুক্তি করে ২০১৮ সালে৷ বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মাট ছয় লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠালেও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নেয়নি৷ এরমধ্যে সামারিক জান্তা ক্ষমতা দখল করায় সেই চুক্তি নিয়ে নতুন করে আর কোনো কথা হচ্ছে না৷
রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে হতাশা আরো বাড়ছে৷ মিয়ানমার সরকারের ওপর তাদের এখনো কোনো আস্থা তৈরি হয়নি৷ এদিকে স্বল্প জায়গায় এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর বসবাসে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা৷ কুতুপালং ক্যাম্পের মুখপাত্র ইউনূস আরমান বলেন, ‘‘এখন এখানে ক্যাম্পে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷ রোহিঙ্গাদের মধ্যেই কেউ কেউ সন্ত্রাস এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ একটি গ্রুপ এখানে বসে মিয়ানমার সরকারের হয়ে কাজ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে৷ এখান থেকে তথ্য পাচার করছে৷ যা আমাদের বেকায়দায় ফেলছে৷ বাংলাদেশ সরকারের কাছেও আমাদের হেয় করছে৷’’
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কক্সবাজারের স্থানীয়দের মধ্যেও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে৷ উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হকের দাবি, ‘‘রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় নিরাপত্তা সংকট তৈরি হচ্ছে৷ তাদের কেউ কেউ মাদকসহ নানা অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ছে৷ ফলে স্থানীয়ভাবে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে৷ তাদের মধ্যে নানা গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে৷’’
শরণার্থী স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ
বাংলাদেশ শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেশনে সই করেনি৷ ফলে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকারের কাগজে কলমে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃত নয়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘শুধু বাংলাদেশ কেন ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই সেই শরণার্থী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি৷ কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা শরণার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছেন৷ যারা এই রিফিউজি স্ট্যাটাসের কথা বলছেন তারা ম্যাক্সিকান বর্ডারে শিশুদের আলাদা করে রেখেছে৷ যা মানবতা বিরোধী৷’’
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের এখন মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই মূল সমাধান৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যাাপরে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷ চীন ও ভারত তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে৷ সমস্যা তো বাংলাদেশের নয়, সমস্যা হলো মিয়ানমারের৷ তাদের এটা সমাধান করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করা উচিত৷
মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শুক্রবার একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে৷ ১১৯টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে থাকলেও, ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ৷ এ বিষয়ে ড ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘ওখানে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তো কিছু নাই৷ তাহলে বাংলাদেশের স্বার্থ কী? মিয়ানমার তো বাংলাদেশের শত্রু না৷’’
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর কারণ ব্যাখ্যা করে একটি বিবৃতিতে দিয়েছে৷ সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন যে জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো কথা নাই৷ সমস্যা সমধানের কোনো উপায়ও প্রস্তাব করা হয়নি৷ রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের রাখাইনে যে অত্যাচার চালানো হয়েছে সে ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি৷ তাদের প্রত্যাবাসন, সেখানে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারেও প্রস্তাবে কিছু নাই৷ রোহিঙ্গা সমস্যার কারণ ও তার প্রতিকারের কোনো কথা না থাকায় বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে৷