1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে কোন পথে বাংলাদেশ?

১০ আগস্ট ২০১৭

বিচারকদের অপসারণে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার রায়ের পর, অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ সরকার এ রায়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানালেও গঠনমূলক সমালোচনা স্বাগত জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷

https://p.dw.com/p/2i1Gb
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan

৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বাংলাদেশের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে৷ এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তাঁকে অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দেয়া হয়েছিল৷ এবার এই রায়ের ফলে সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যাস্ত হয়, যার প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি৷

এই রায়ে বর্তমান সংসদকে অপরিপক্ক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থারও সমালোচনা করা হয়৷ একই সঙ্গে সংবিধানের ১৬১ অনুচ্ছেদে বিচারকদের শৃঙ্খলা-বিধি নিয়েও কথা বলা হয়৷ প্রশ্ন তোলা হয় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে, যেখানে সংসদ সদস্যদেরও দলের বিপক্ষে গিয়ে ভোট দেয়ার অধিকার খর্ব করা হয়৷

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘এ রায় গ্রহণযোগ্য না৷ কিন্তু আমরা এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল৷ আপিল বিভাগ যে যুক্তিতে তা বাতিল করেছেন, তা যুক্তিযুক্ত নয়৷ কোনো সংশোধনী দ্বারা কারও বিরুদ্ধে কিছু করার অভিপ্রায় ছিল না এই সংসদের৷ আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিচার বিভাগ ও সংসদ কোনো পাওয়ার কনটেস্টে নামেনি৷’’

আইনমন্ত্রীর ভাষ্য, ‘‘আমরা মনে করেছি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি অত্যন্ত অস্বচ্ছ ও নাজুক৷ তাই এর পরিবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের স্বাধীনতা ও তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা রক্ষা করা হয়েছিল বলেও আমাদের বিশ্বাস৷’’

এর একদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল বলেন, ‘‘ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ তাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনতে হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করতে হবে৷ সংবিধানে যেহেতু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল না, সেহেতু এটা রাখা সংবিধান পরিপন্থি৷ আপিল বিভাগের রায়টি অপরিপক্ক, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি কি প্রধান শিক্ষক আর অন্য বিচারপতিরা ছাত্র যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাঁকে (প্রধান বিচারপতি) অন্য বিচারপতিদের পরিচালনা করতে হবে? সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে তো বিচারপতিরা সবাই স্বাধীন৷’’

এর জবাবে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘যে কোনো রায়ের গঠনমূলক সমালোচনা হতে পারে, কেননা গঠনমূলক সমালোচনা না হলে বিচারবিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তবে আমরা সরকার বা বিরোধীদলের ট্র্যাপে (ফাঁদে) পড়ব না৷’’

বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খাইরুল হকের দেয়া বক্তব্য নজরে আনলে প্রধান বিচারপতি এ সব কথা বলেন৷

এ সময় জয়নুল আবেদিনকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনারা সংযত থাকবেন৷ রায় নিয়ে রাজনীতি করবেন না, ইতিহাসই একদিন এ রায়ের বিচার করবে৷’’

এদিকে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়৷ বলা হয়, এই রায়ের মাধ্যমে সামরিক শাসকের ফরমান ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ সরকারের এই ভূমিকার সমালোচনা করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকার এখন বিচার বিভাগের প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নিয়েছে৷’’

তাঁর কথায়, ‘‘আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, এই রায়ের যে অবজারভেশন, এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের কথা৷ সেটাই সুপ্রিম কোর্ট বলেছে৷ সুতরাং দেশের ১৬ কোটি মানুষ এই রায়ের অবজারভেশনের সঙ্গে আছে এবং তাঁরা একমত৷’’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘‘এই রায় দেওয়ার পরে, অবজারভেশন দেওয়ার পরে মন্ত্রিসভায় যে আলোচনা হয়েছে এবং সরকারের কিছু মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা যে ভাষায় কথা বলছেন, আমি জানি না আপনারা ভালো বলতে পারবেন, তা আদালত অবমাননার দায়ে পড়ে কিনা৷’’

একই দিন ঢাকায় এক আলোচনা সভায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির প্রবণতা বিপজ্জনক৷ এটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে৷’

জানা গেছে, সরকার সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ব্যাপারে রিভিউ আবেদন করবে৷ আর সেই রিভিউ করতে তারা সময় নিতে চায়৷ এক মাসের মধ্যে রিভিউ করতে হলেও এই সময়টি বাড়িয়ে নিতে চায়৷ এছাড়া বৃহস্পতিবার বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, সংবিধান সংশোধন ছাড়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফেরত আনা সম্ভব নয়৷

‘এটা একটা ঐতিহাসিক রায় বলে আমি মনে করি’

তিনি বলেন, ‘‘সংসদ আইন প্রণয়ন করবে এবং সংবিধান হলো সবার উপরে৷ আমি এ কথাও বারে বারে বলেছি, যে আইন হবে সে আইনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য যত রকম কিছু ‘সেভ গার্ড’ থাকা দরকার সেটা থাকবে৷ এবং সে আইনটাকে অসংবিধানিক ভালো-মন্দ সব বিচার করার ক্ষমতা আদালতের থাকবে৷ কিন্তু মূল সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদকে কোনো আদালত বিচার করার ক্ষমতা রাখে না৷’’

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ অবশ্য এর আগেই বলেন, ‘‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনা-আপনি চলে এসেছে৷ এর জন্য সংবিধান সংশোধনের দরকার নেই৷’’

এই পরিস্থিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই সুপ্রিম কোর্টের রায় সবার মেনে নেয়া উচিত, যদি তা কেনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়৷’’

তিনি বলেন,  ‘‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় অতীতে অনেক সাহসী রায় দিয়েছে৷ আবার এ-ও সত্য যে অনেক বিচারপতি সামরিক শাসনের সহযোগী হয়েছেন৷ তার বৈধতা দিয়েছেন৷’’

এই অধ্যাপকের কথায়, ‘‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিল কওে সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই আরো সংহত করেছে৷ এটা একটা ঐতিহাসিক রায় বলে আমি মনে করি৷ আমার মনে হয়, সবার এটা মেনে নেয়া উচিত৷’’

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...