1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক হত্যার বছরে স্বজনদের লড়াই

দিল আফরোজ জাহান
২১ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিকের প্রাণ গেছে এ বছর৷ শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেই প্রাণ হারান পাঁচ সাংবাদিক৷ তারপর রহস্যজনক মৃত্যু হয় এক নারী সাংবাদিকের এবং অক্টোবরে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আরো একজনকে৷

https://p.dw.com/p/4m3ha
Bangladesch Durga Puja Anschlag Presseschau
ছবি: Shamima Nasrin Lucky

রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডার্স, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য মতে, গত ১০ বছরে প্রাণ হারিয়েছে ২৬ জন  সাংবাদিক ও  সংবাদকর্মী - ২০১৪ সালে ১ জন, ২০১৫ সালে ৪ জন সাংবাদিক ও ১ জন সংবাদকর্মী, ২০১৬ সালে ১ জন,  ২০১৭ সালে  ২ জন, ২০১৮ সালে ১ জন, ২০১৯ সালে প্রাণ হারায়নি কোনও সাংবাদিক, ২০২০ সালে ১ জন, ২০২১ সালে ৩ জন, ২০২২ সালে ১জন, ২০২৩ সালে ৩ জন, এবং ২০২৪ সালে ৭ জন সাংবাদিক ও ১ জন সংবাদকর্মী৷ 

১০ অক্টোবর দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিমকে বাসায় ঢুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷

১২ অক্টোবর ময়মনসিংহের সদর উপজেলায় বাড়ির সামনে তারাকান্দা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি স্বপন কুমার ভদ্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ পরের দিনই হত্যায় অভিযুক্ত সাগর মিয়াকে আটক করে পুলিশ৷ সাগরের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, পূর্ববিরোধের জের ধরে হত্যা করা হয় অবসরে যাওয়া সাংবাদিক স্বপন কুমার ভদ্রকে৷ কর্মরত থাকা অবস্থায়, তিনি মাদকের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে পত্রিকায় লিখতেন৷ আসামি সাগরের মাদকসেবন এবং মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ৷

২৭ আগস্ট দিবাগত রাতে হাতিরঝিল থেকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে নারী সাংবাদিক রাহনুমা সারাহ‌র লাশ৷ রাহনুমার পরিবার তার এই রহস্যজনক মৃত্যুতে, একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন থানায়৷

তবে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্মরত অবস্থায় নিহত পাঁচ সাংবাদিকের হত্যা মামলা নিতে গড়িমসি করে পুলিশ৷ রিপোর্টাস উইদআউট বর্ডার্সের তথ্য মতে, ১৮ জুলাই ঢাকার যাত্রাবাড়ী জেলায় ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদীকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ৷ পরদিন ভোরের আওয়াজ পত্রিকার প্রতিবেদক শাকিল হোসেন এবং দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার প্রতিবেদক আবু তাহের মো. তুরাব দুজনকেই সিলেট শহরে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ একই দিনে ঢাকায় সংবাদ সংগ্রহের সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়র৷

৪ আগস্ট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি এক প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সাংবাদিক হত্যার নিন্দা জানিয়ে দাবি করেন, দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করেছে সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিককে৷ তিনি সিপিবির সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সদস্য ও রায়গঞ্জ উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং রায়গঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷

মামলা দায়ের করতেই প্রায় এক মাসের অপেক্ষা

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের অস্থিতিশীল আবস্থায় ক্ষুদ্ধ বিক্ষোভকারীদের হামলার মুখে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে পুলিশ৷ এ কারণে, আন্দোলন চলাকালে নিহত সাংবাদিকদের বিচার চেয়ে হত্যা মামলা দায়ের করতেও দেরি হয় নিহতদের পরিবারের৷

১৯ আগস্ট অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আব্দুল মোমেনের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন নিহত আবু তাহের মো. তুরাবের ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ৷ এর আগে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করলেও পুলিশ এটিকে জিডি (সাধারণ ডায়েরি) হিসেবে গ্রহণ করে৷

অন্যদিকে, ২০ আগস্ট ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়র হত্যা মামলা দায়ের করতে গেলে নিহতের মা সামসি আরা জামানকে প্রায় ১২ ঘন্টা বসিয়ে রাখা হয় নিউমার্কেট থানায়৷

আগের চেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের কার্টুনিস্টরা

এই হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎ ডয়চে ভেলেকে জানান, প্রিয়র মা মামলা করতে থানায় গেলে বিভিন্ন অজুহাতে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি৷ সকাল ১১ টায় থানায় গেলেও, মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতার চাপে মামলা নিতে বাধ্য হয় পুলিশ৷ এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত অজ্ঞাতনামা ৩০-৪০ জন পুলিশ এবং বিজিবি বাহিনীর কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়৷

এরও এক মাস পর ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত সাংবাদিক মেহেদী হাসানের বাবা মোশাররফ হোসেন৷ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজার আদালত যাত্রাবাড়ী থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন৷

সহকর্মীর প্রাণ বাঁচিয়ে মারা গেলেন মেহেদি

১৮ জুলাই দুপুরে টিএসসিতে ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র ফটোসাংবাদিক রোহেত রাজিব৷ যাত্রাবাড়ি এলাকায় পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের খবর পেয়ে যাত্রাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন রোহেত৷ যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার টোল প্লাজার কাছেই ছবি তোলার সময় উড়ে আসা ইটের আঘাতে পথেই লুটিয়ে পড়েন এই ফটো সাংবাদিক৷

রোহেত রাজিব ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি ছবি তোলার সময় আমার পায়ে একটি আঘাত লাগে৷ সাথে সাথে পথেই পড়ে যাই৷ আমি উঠে দাঁড়াতে পাড়ছিলাম না৷ তখন পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্য সংঘর্ষ চলছে৷ চারিদিকে এলোপাথারি গোলাগুলি হচ্ছিল৷ ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদি দৌড়ে এসে আমাকে এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে যায়৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকটা জায়গা বয়ে নিয়ে যায় মেহেদি৷ তারপর রাস্তার পাশে একটা জায়গায় বসিয়ে পানি খাওয়ায়৷ এবং আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা গাড়িতে তুলে দেয় সে এবং ফিরে যায় সংবাদ সংগ্রহে৷ হাসপাতালে পৌঁছানোর পর জানতে পারি আমার পায়ের হাঁড় ভেঙে গেছে৷ ঘণ্টা খানেক পরে বাসায় এসে ফেসবুকে একটা পোস্টে দেখি যাত্রবাড়িতে একটা ছেলের মৃত দেহ পড়ে আছে৷ চিনতে অসুবিধা হয়নি৷ এটা তো আমাদের মেহেদি, যে কিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে৷ কয়েক ঘণ্টা পরেই সে নিজেই মরে পড়ে থাকে রাস্তায়৷ বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ মেহেদি না থাকলে হয়তো আমি নিজেই ঐদিন মারা পড়তাম৷’’

‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো’

‘‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো'', তাহির জামান প্রিয় মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শেষ এই বাক্যটি বলেছিলেন বন্ধু সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎকে৷ তারপরেই পুলিশের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন প্রিয়৷

মানবাধিকারকর্মী সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎ ডয়চে ভেলেকে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে একটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে ১৯ জুলাই সকালে সংসদ ভবনের সামনে যান তিনি৷ পুলিশ সেখানে দাঁড়াতে না দিলে, দুপুরের পরে নিউমার্কেটের সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় যান তারা৷ সেখানেই প্রিয়র সাথে দেখা হয় ফারিয়া উলফাৎ-এর৷

ফারিয়া উলফাৎ বলেন, ‘‘সায়েন্স ল্যাবরেটরি সীমানা সংলগ্ন ল্যাবএইড সেন্ট্রাল রোড এলাকায় ছাত্র- জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম৷ সাথে প্রিয়ভাই ছিল ছবি তোলার কাজে৷ একসময় এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালে গুলি করতে থাকে পুলিশ৷ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশের একটি দল দ্রুত পিছন থেকে গ্রিনরোডের মুখে চলে আসে৷ আমরা সবাই পুলিশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ি৷ অন্যদিকে, আকাশে নিরাপত্তা বাহিনীর হেলিকপ্টার ও ড্রোন থেকে আমাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিল৷ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গুলির শব্দ৷ এ সময় পুলিশের একটি দল সায়েন্স ল্যাবের দিক থেকে এবং অপর একটি দল ল্যাব এইডের দুই ভবনের মাঝের রাস্তা ধরে সেন্ট্রাল রোডের দিকে এগিয়ে আসে৷ তখন প্রিয় ভাই বলছিলেন, ‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো৷' মুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পাই৷ ভেবেছিলাম সাউন্ড গ্রেনেড৷ দৌঁড়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করি৷ সবার পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম আমি৷ বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম পুলিশের অবস্থান দেখার জন্য৷ টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় প্রথমে বুঝতে পারিনি৷ তারপর দেখি পেছনে একজন পড়ে আছে৷ মানুষটার মাথার চারিদিকে অনেক রক্ত৷ ধোঁয়া সরে যেতেই দেখি পড়ে থাকা বডিটা প্রিয় ভাইয়ের, তার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে৷ ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আবার গুলি ছুড়তে থাকে৷ আনতে পারিনি তাকে৷ প্রিয় ভাইয়ের দেহটা রাস্তায় পড়ে থাকে৷’’

এফআইআর তথ্য থেকে জানা যায়, অজ্ঞাতনামা ৪-৬ জন আন্দোলনকারী ছাত্র প্রিয়র মৃতদেহ ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আইডিয়াল কলেজ রাস্তা দিয়ে যাওয়ারর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু পুলিশের অনবরত গুলির মুখে প্রিয়র মৃতদেহটি ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয় তারা৷

ফারিয়া উলফাৎ আরো বলেন, ‘‘হয়তো অল্প কয়েক ইঞ্চির জন্য গুলিটা আমার মাথায় না লেগে প্রিয় ভাইয়ের মাথায় লাগে৷ গুলি লাগার আগ মুহূর্তে প্রিয় ভাই বলেছিলেন ‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো৷' বারবার আমার এই কথাটা মনে পড়ে৷ আমি অনেকদিন ঘুমাতে পারিনি এই ঘটনার পরে৷ আমার মধ্যে এক ধরনের সার্ভাইভাল গিল্ট কাজ করে৷ আমাকে ঐদিন নিজের জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে পালাতে হয়েছিল৷ একসাথে আমাদের আর থাকা হয়নি৷’’

‘সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে হবে'

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাংবাদিক হত্যা অনাকাঙ্খিত৷ সাংবাদিকরা প্রফেশনাল কাজে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে যায়৷ সেখানে তাদের হত্যা হলে, সেটা অনাকাঙ্খিত এবং এই হত্যার জোরালো বিচার আমরা দাবি করি৷ সুষ্ঠু বিচারের আওতায় এনে, যে দোষী হবে, তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে৷’’

তিনি আরো বলেন, আগামিতে এবং বর্তমান সরকারের আমলেও সাংবাদিকরা যেন সুষ্ঠু পরিবেশে তাদের সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে পারে, ন্যায়-নিষ্ঠ, অবজেক্টিভ রিপোর্ট করতে পারে – এটাই সরকারের প্রতি আমার আহ্বান৷ দেশের চলমান পরিস্থিতিতে, মানুষ আইনের সহায়তা পাচ্ছে না৷ বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই, চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি ঘটে যাচ্ছে৷ এই অবস্থায় বর্তমান সরকারের প্রতি আমার আহ্বান, তারা যেন সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করে৷ আর আইন- শৃঙ্খলাবাহিনীকে বলবো, সাংবাদিক যদি কোথাও সংবাদ সংগ্রহে যায়, তারা যেন অবশ্যই সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়টি কনসিডার করে৷ সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহে যাবে এবং নিরাপদে ফিরে আসবে এটাই আমাদের কাম্য৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য