সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে না!
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির পটস্ডাম ইনস্টিটিউট অব ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের একদল গবেষক নতুন এক মডেলে গবেষণা করেন৷ বুধবার প্রকাশিত সেই গবেষণার ফলাফলে বলা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২৩০০ সালের মধ্যে ০ দশমিক ৭ থেকে ১ দশমিক ২ মিটার বেড়ে যাবে৷
পরিবেশ বিষয়ক বিখ্যাত জার্নাল নেচার কমিউনিকেশন্সে প্রকাশিত এই গবেষণায় আরো বলা হচ্ছে, ‘‘এমনকি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকিয়েও রাখা যায়, সিস্টেমের জড়তার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আটকে রাখা যাবে না৷''
শুধু তাই নয়, কার্বন ডাইঅক্সাইডের উদগীরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনতে যদি দেরি হয়, তাহলে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য ২০ সেন্টিমিটার করে পানির উচ্চতা বাড়বে৷
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের স্বরূপ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ ও হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে৷ ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে রাখার কথা বলা হয়েছে৷
এছাড়া, জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকি কমিয়ে আনতে এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিরসনও সার্বিকভাবে শূন্যে নামিয়ে আনার শর্ত রাখা হয়েছে৷
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন৷ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের হার তো কমছেই না, বরং বাড়ছে, এবং তা আরো অন্তত এক দশক এই হার অব্যাহত থাকবে৷
‘‘গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ যদি এখনই বন্ধ করে দেয়া হয়, তারপরও এরই মধ্যে আমরা পরিবেশের এতটাই ক্ষতি করে ফেলেছি যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আগামী কয়েক শতকে বেড়েই যাবে৷'' গবেষণাটিতে বলা হয়েছে৷
তবে গবেষকরা বলছেন, যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবার কথা বলা হয়েছে, তা নিলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির উপর তা কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিরূপন করা হয়নি এখনো৷
উপকূল ও বাংলাদেশ
গবেষণায় বলা হচ্ছে, ১ দশমিক ২ মিটার পানির উচ্চতা বৃদ্ধি মানে হলো, বাংলাদেশসহ ভিয়েতনাম ও ভারতের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে ভয়াবহ বিপদ নেমে আসা৷ নিউ সাউথ ওয়েলেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন চার্চের মতে, এ এলাকাগুলোতে এক মিটার উচ্চতার ঝুঁকিতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ বাস করেন৷ তাদের বিপদ সবচেয়ে বেশি৷
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সামনে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ আগের অনেক গবেষণায় দেখানো হয়েছিল যে, ২০২০ সাল নাগাদ সমুদ্রে পানির উচ্চতা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যার ফলে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ এলাকা অধিক হারে বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে৷ বাংলাদেশের ওপর সম্পাদিত গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ১ ও ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ সাল নাগাদ ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে৷
একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে৷ এর ফলে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৭ সেন্টিমিটার বাড়লে গোটা সুন্দরবনই পানিতে তলিয়ে যাবে৷ ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে অবস্থিত 'লোহাচরা'ও 'সুপারিভাঙ্গা' নামের দুটি দ্বীপ হারিয়ে গেছে৷ লোহাচরা দ্বীপের মাত্র ১ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত প্রায় দেড় লাখ জনসংখ্যার 'সাগরদ্বীপের ৩৩ দশমিক ৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকা গত ৩০ বছরে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে৷
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ভোলা দ্বীপও গত চার দশকে প্রায় ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা হারিয়ে বর্তমানে ১৯৬৫ সালের তুলনায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে৷
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এখনই
উদ্যোগ যা নেয়া হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন জন চার্চ৷ তিনি বলেন, ‘‘২৩০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি রোধ করতে হলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আরো অনেক বাড়াতে হবে, এবং তা এখনই৷''
গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস ইয়ান লোয়ি বলেন, ‘‘এই গবেষণাটি আরেকবার আমাদের মনে করিয়ে দিলো যে, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উপকূলে কতটা ঝুঁকি তৈরি করে ফেলেছে৷''
প্রাকৃতিক কারণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের উচ্ছেদ ও জলবায়ু শরণার্থী হয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়াসহ এসব দেশের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি করবে বলে মত তাঁর৷
জেডএ/এসিবি (ডিপিএ)