সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬গত বছরের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় তাঁর টুইট-বার্তা রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল৷ বাংলাদেশ সফরের ছবি আর খবর দিয়ে তিনি রীতিমতো সংবাদমাধ্যমকে পেছনে ফেলে দেন৷ সাংবাদিকদের তখন ব্রেকিং নিউজের প্রধান উত্স হয়ে দাঁড়ায় মোদীর টুইট৷ বাংলাদেশ সফরে মোদীই যেন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম৷
কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মোদীর সফর, এমনকি তাঁর সফরের এক বছরেরও বেশি সময় পর কেরির সফরেও এই টুইট তত্পরতা বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের তত্পরতা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেখা যায়নি৷
এটা থাকলে যে কত ভালো হয় তার উদাহরণ আবার বাংলাদেশেই আছে৷ ‘ম্যাজিস্ট্রেটস, অল এয়ারপোর্টস অফ বাংলাদেশ' নামে একটি ফেসবুক পেজ আছে৷ এটি এয়ারপোর্টে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটদের ফেসবুক পেজ৷ এই পেজে এয়ারপোর্ট সংক্রান্ত কোনো সুবিধা-অসুবিধা বা হয়রানির অভিযোগ করা যায়৷ এই পেজটি এরই মধ্যে ইন্টারঅ্যাকটিভ হওয়ার কারণে তুমুল জনপ্রিয়৷ পেজটির লাইক প্রায় তিন লাখ৷ আর এই পেজে অভিযযোগ করলে সাধারণ মানুষ প্রতিকারও পান৷ ফলে এই পেজটিই এখন হয়ে উঠেছে এয়ারপোর্ট সংক্রান্ত অভিযযোগ ও প্রতিকারের, বলতে গেলে একমাত্র মাধ্যম৷ সাংবাদিকরাও এখান থেকে দরকারি অনেক তথ্য পান৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ রীতিমতো একটি নিউজ পোর্টাল চালায়৷ আর এই নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পেজটি বেশ জনপ্রিয়৷ এই পেজেও সাধারণ মানুষ অভিযোগ জানাতে পারেন৷ প্রশ্ন করেন নানা বিষয়ে৷ জবাবও পান৷ প্রতিকারের ফলোআপ পান এখানেই৷ এই পেজের মাধ্যমে অপরাধীদের ছবি দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়৷ পুলিশের কোনো নির্দেশনা এবং নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত খবরাখবরও প্রকাশ করা হয়৷ ব্লগার এবং লেখক ড. অভিজিত্রায় হত্যার সন্দেহবাজনদের ভিডিও ফুটেজ এই পেজেই প্রথম প্রকাশ করা হয়৷
ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ব়্যাব)-এর নিজস্ব ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ফেসবুকও পেজ আছে৷ এই ফেসবুক পেজও বেশ জনপ্রিয়৷ গুলশান হামলার পর সন্দেহভাজন নিখোঁজদের তালিকা প্রকাশ ও সিসিটিভির ফুটেজ প্রকাশ করে ব়্যাবের পেজটি রীতিমতো হইচই ফেলে দেয়৷
এর বাইরে শুল্ক এবং গোয়েন্দা অধিদপ্তর এবং ভ্যাট ইন্টেলিজেন্সের ফেসবুক পেজও বেশ ইন্টারঅ্যাকটিভ৷
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে৷ সব মন্ত্রণালয়ের একটি করে ফেসবুক পেজও আছে, কিন্তু টুইটার অ্যাকাউন্ট নেই৷ তবে অধিকাংশ পেজই নিয়ম রক্ষার জন্য, ইন্টারঅ্যাকটিভ নয়৷ ওয়েব সাইটগুলোতেও সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ আছে৷
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে চালানো একটি ফেসবুক পেজের কথা৷ পেজটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালায় কিনা তা স্পষ্ট নয়৷ ওয়েবসাইটে ওই ফেসবুক পেজের লিংক নেই৷ আর পেজটি ভেরিফায়েডও নয়৷ তবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর নিজস্ব ফেসবুক পেজে খুব সক্রিয়৷ তাঁর ফেসবুক পেজে নানা তথ্য নিয়মিত আপডেট হয়৷ সবাই সেখান থেকে তথ্য পান৷
তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়েরও (আইসিটি) নিজস্ব ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ফেসবুক পেজ আছে৷ তবে তা ভেরিফায়েড নয়৷ আর সেখানে তাদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু খবরের লিংক ছাড়া আর কোনো তথ্য তেমন একটা দেখা যায় না৷ তবে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক তাঁর নিজস্ব ফেসবুকে বেশ সক্রিয়৷ টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারনা হালিমও ফেসবুকে সক্রিয়৷
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুক এবং টুইটার – দু'টোতেই সক্রিয়৷ তাঁর ফেসবুক পেজের স্ট্যাটাস প্রায়ই খবর হয়৷ তিনি প্রয়োজন হলে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা এবং তথ্য দেন সেখানে৷
বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেন৷ তবে সরকার চাইছে এই ফেসবুক যেন একান্ত ব্যক্তিগত না হয়ে সরকার ও মন্ত্রণালয়েরও কাজে লাগে৷ মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় ফেসবুক এবং টুইটার ব্যবহার নিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘মাঠ পর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা ফেসবুকে একান্ত ব্যক্তিগত এবং নিজ কর্মের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বিষয় শেয়ার করছেন৷ প্রশাসনের ভাবমূর্তির সঙ্গে এ সব বিষয় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়৷ উদ্ভাবনমূলক, সরকারের কাজের ইতিবাচক দিক, যা অন্যকে উদ্বুদ্ধ করবে, এমন সব বিষয় ফেসবুকে শেয়ার করার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করা হলো৷'' এর বাইরে গতমাসেই সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি ই-মেল ব্যবহারের নির্দেশও দেয়া হয়েছে৷
জার্মানির মিউনিখে জুলাই মাসের শেষ দিকে জঙ্গি হামলার সময় সেখানকার পুলিশ নিয়মিত আপডেট দিয়েছে টুইটারে৷ সেই টুইটারের তথ্য শুধুমাত্র জার্মানি নয়, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও ব্যবহার করেছে৷ আর বাংলাদেশে গুলশান হামলার সময় সাংবাদিকরা তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বেশ ঝামেলায় পড়েন৷ নিয়মিত আপডেট দেয়ার রীতি বা ব্যবস্থা না থাকায় সাংবাদিকরা যে যার নিজস্ব সোর্স থেকে তথ্য দেন৷ ফলে তথ্য নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিও দেখা দেয়৷ শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামলাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় প্রশাসন৷
জার্মান পুলিশের মতো বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষেও আপডেট দেয়া সম্ভব কিনা ওই সময়ে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমরা ভবিষ্যতে ফেসবুকের মাধ্যমে আপডেট দিতে চেষ্টা করব৷ তবে টুইটার এখানে তেমন জনপ্রিয় নয়৷''
‘ম্যাজিস্ট্রেটস, অল এয়ারপোর্টস অফ বাংলাদেশ'-এর অ্যাডমিন মোহাম্মদ ইউসুফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফেসবুক আমাদের চমত্কার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে৷ এর মাধ্যমে আমরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি৷ তাঁরা অভিযোগ করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন৷ আমরা জবাব দিচ্ছি, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি৷''
মোহাম্মদ ইউসুফ আরো বলেন, ‘‘সরকারের সব দপ্তরই চাইলে এখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে অনেক সেবা দিতে পারে, তাদের মতামত নিতে পারে৷ সরকারের নির্দেশনা আছে, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন মাইন্ড সেটের পরিবর্তন৷ আমরা পেরেছি, সবাই পারবে, এটাই আমি মনে করি৷''
বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় প্রায় সাত কোটি৷ আর ফেসবুক ব্যবহার করেন প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী৷
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য প্রযুক্তি বিকাশের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের অধীনে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে৷ ২০০৭ সাল থেকে এই প্রকল্প শুরু হয়৷ এই প্রকল্পের অধীনে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং কর্মকর্তাদের জনস্বার্থে ফেসবুক ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে৷ প্রকল্পের জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাইমুজ্জামান মুক্তা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের প্রত্যেকের একটি করে ফেসবুক পেজ আছে৷ তারা সেখানে সাধারণ মানুষের কথা শোনেন৷ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন৷ এছাড়া সরকারের নীতি নির্ধারন ও নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে৷ সেখানে তারা নানা বিষয নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন৷ এটা ক্লোজড গ্রুপ৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য ফেসবুক পেজ বাধ্যতামূলক নয়৷ তবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে৷ সামাজিক যোগযোগের মাধ্যম এক বিশাল শক্তি এই শক্তিকে কাজে লাগাতে চায় সরকার৷''
পাদটীকা: এই প্রতিবেদন তৈরির সময়ই খবর পাওয়া গেল বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ফেসবুক ও টুইটারে যুক্ত হয়েছেন৷ ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে খালেদা জিয়ার টুইটারে যুক্ত হওয়ার কথা জানান তাঁর তথ্য কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান৷
আপনি কি কিছু যোগ করতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷