ভারতে জাতীয় সংগীত অবমাননা
১৩ ডিসেম্বর ২০১৬গোটা দেশের সিনেমা হলগুলোতে ছবি শুরুর আগে জাতীয় সংগীত বাজানোর সময় উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতকে শ্রদ্ধা জানানো বাধ্যতামূলক করে শীর্ষ আদালতের নির্দেশিকা জারির পর, গত রবিবার দক্ষিণী শহর চেন্নাইয়ের একটি সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজানোর সময় কিছু দর্শক আসনে বসে থাকলে, তাই নিয়ে জনা কুড়ির অন্য একদল দর্শক তার প্রতিবাদ করে৷ এই নিয়ে শুরু হয় বচসা এবং বিরতির পর তাঁদের ওপর চড়াও হয়ে তাঁদের পেটানো হয়৷ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, একদিকে যখন জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছে, রূপালী পর্দায় জাতীয় পতাকা উড়ছিল, তখন জনা দশেক দর্শক না উঠে আসনে বসে সেলফি তুলছিলেন৷
জাতীয় পতাকার প্রতি, দেশের প্রতি এই অবমাননা নাকি সহ্য করা যায় না৷ জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ৯-১০ জন দর্শক বসেছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে দু-তিন জন নারীও ছিলেন৷ ধ্বস্তাধস্তির সময় পুলিশ আসে এবং তদন্তের জন্য দু'দলকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর, চেন্নাই পুলিশ ১৯৭১ সালের জাতীয় সংগীত অবমাননা বিরোধি আইনের সংস্থান অনুযায়ী সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে৷
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা জারির পর জাতীয় সংগীত অবমাননার অভিযোগে এই প্রথম মামলা৷ দু'জন মহিলাসহ অপরপক্ষের অভিযোগ যে, তাঁদের দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় এবং তাঁদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়৷ এদের মধ্যে একজন আইনের ছাত্রী৷ তিনি জানান, না দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করতে চায়নি সে৷
প্রসঙ্গত, সিনেমা হলে ছবি শুরুর আগে জাতীয় সংগীত বাজানোর সময় উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান জানানোটাকে সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের প্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন শীর্ষ আদালতের এক বেঞ্চ৷ এই নির্দেশ অমান্য করলে তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে৷
এই নির্দেশ অবশ্য অনেকেই পছন্দ করছেন না৷ তাঁরা মনে করেন, উঠে দাঁড়ানো বা না দাঁড়ানোটা দেশপ্রেমের অভাব বা জাতীয় সংগীতকে অপমান করা নয়৷ জোর করে দেশপ্রেম কারোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না৷ এটা অহেতুক৷ জাতীয়তাবাদ বা দেশভক্তির মতো অনুভূতিগুলি আসবে মনের ভেতর থেকে৷ এ সব লোকদেখানো হতে পারে না৷ টেলিভিশনে জাতীয় সংগীত বাজানো হলে, ঘরে ঘরে আইনের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় সহজেই৷ কেউ দেখতে যাচ্ছে না৷ কাজেই দেশাত্মবোধ ব্যাপারটা সর্বোতভাবে নিজস্ব অন্তরের৷
এই প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক দেবদাস ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘দেখুন সাংবিধান বা সুপ্রিম কোর্টের আদেশ নিয়ে আমার বলার কিছু নেই৷ তবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর শ্রদ্ধা রেখে ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে, এই আদেশে আমি খুশি হতে পারিনি৷ এতে দেশাত্মবোধ বাড়ে কিনা জানি না৷ কারণ তাই যদি হয়, তাহলে শুধু সিনেমা হলে কেন? থিয়েটার নয় কেন?টেলিভিশনে নয় কেন? স্কুল, কলেজ, অফিসে নয় কেন? দিনের কাজ শুরু করার আগে জাতীয় সগীত গাইতে হবে, না হলে জেলে পোরা হবে – এটা মন থেকে মেনে নিতে পারছি না৷''
‘‘দেশে যখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সেখানে এই ধরনের আদেশের মধ্যে কোথাও একটা বৈপরিত্য আছে বলে মনে হয়'', ডয়চে ভেলেকে জানান সমাজবিজ্ঞানী দেবদাস ভট্টাচার্য৷
তিনি জানান যে, তাঁর অনেক পরিচিত বন্ধু-বান্ধবরাও এই অভিমত পোষণ করেন৷ তবে আবারও বলি, আইন হলে তা নাগরিক হিসেবে মানতেই হবে৷ সবথেকে বড় কথা যিনি জাতীয় সংগীত লিখেছিলেন, বেঁচে থাকলে তিনি এ আইনে খুশি হতেন কিনা সন্দেহ৷ তাই বলছিলাম, মহামান্য শীর্ষ আদালত যদি আরও একটু ভেবে দেখতো, ভালো হতো৷ এবার থেকে সিনেমা দেখতে যাবার আগে এটা মাথায় রেখেই যেতে হবে, না হলে নয়৷ তাই তাঁর কথায়, ‘‘এর চেয়ে বরং ডিভিডি কিনে ঘরেই দেখবো৷''
নাগরিক সমাজের অন্য একটা অংশ অবশ্য মনে করেন, পছন্দ হলেই মানবো, না হলে নয়, এটা কোনো কথা না৷ যেসব আইন পছন্দ নয়, তা মানার দায় নেই, এটা হতে পারে না৷
উল্লেখ্য, সিনেমা হলে জাতীয় সংগীত বাজানোর প্রধান যুক্তি রোজ হাজার হাজার সিনেমা হলে লাখ লাখ লোক ছবি দেখতে যাচ্ছে, কাজেই দেশপ্রেমের বার্তা অনেক বেশি লোকের কাছে পৌঁছাবে৷
আপনি কী মনে করেন? সিনেমা হলে কি জাতীয় সংগীত বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত? লিখুন নীচের ঘরে৷