সীতাকুন্ডের বনাঞ্চলে ‘পরিবেশের শত্রুদের’ হানা
১১ জুন ২০১০১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাসে মারা গিয়েছিল এক লাখ আটত্রিশ হাজার মানুষ৷ মৃতদের মধ্যে ছিলেন আবুল কালাম-এর বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়রা৷ কিন্তু সমুদ্র তটে থাকা সত্ত্বেও মারা পড়েননি আবুল কালাম৷
আবুল কালাম এমন বিখ্যাত কোন ব্যক্তি নন৷ সীতাকুণ্ড উপকূলে বাস তাঁর৷ ১৯৯১ সালের মে মাসের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছাসের সময় তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল একটি নারিকেল গাছ৷ সঙ্গে বাঁচিয়েছিল তার স্ত্রীকেও৷ শুধু তারাই নয়, আরো অনেককে বাঁচিয়েছিল সীতাকুণ্ডের বনাঞ্চল৷
কিন্তু এখন আর তেমনটা সম্ভব নয়৷ কারণ সীতাকুণ্ডের বনাঞ্চল দিনে দিনে উজাড় হচ্ছে৷ দিনেরাতে নির্বিচারে গাছ কাঁটা হচ্ছে, সমতল করা হচ্ছে সমুদ্র সংলগ্ন এলাকা৷ আর তাই প্রাকৃতিক এই দেয়াল হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে৷
জানতে চাইছেন, ঠিক কী পরিমাণ গাছ কাটা হচ্ছে সীতাকুণ্ডে ? বেসরকারি সংগঠন ‘প্ল্যাটফর্ম অন শিপব্রেকিং লবি গ্রুপ'এর প্রধান মোহাম্মদ আলী শাহিন জানাচ্ছেন, ‘‘প্রায় ৫০ হাজারের মতো গাছ কাঁটা হয়েছে এবং ঐখানে (সীতাকুন্ড) যে সবুজ বেষ্টনি ছিল তার সত্তর শতাংশ ইতিমধ্যে ধংস করা হয়েছে৷''
কিন্তু কারা কাটছে এই গাছ ? আর কেনই বা কাটছে ? শাহিন জানান, ‘‘শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড করার জন্য এই খাতের ব্যবসায়ীরা এসব গাছ কেটে নতুন নতুন ইয়ার্ড বানাতে চাচ্ছে৷''
চট্টগ্রামের পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ তার ওপরে জাহাজ ভাঙা শিল্পের নামে জন্মভূমি উজাড় হয়ে যাওয়া – পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলছে৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানিয়েছেন, সীতাকুণ্ডের উপকূলে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে তেমন একটা বনভূমি আর নেই৷ জাহাজ ভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এসব বনভূমি উজাড় করছে বলেও মত তাঁর৷
কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, মানে সেই জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকরা কী বলছেন ? ‘বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস এ্যাসোসিয়েশন'এর সভাপতি জাফর আলম জানালেন, ‘‘জাহাজ ভাঙা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্প৷ আমরা হাজার হাজার মানুষের জন্য কাজের সংস্থান করেছি এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের সম্পদের পরিমাণ তিন বিলিয়ন ডলার৷'' জাফর জানালেন, এই শিল্প এখন ব্যাপকহারে বাড়ছে৷ আর তাই, তারা আরো নতুন নতুন জায়গায় জাহাজ ভাঙা কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন৷
সীতাকুণ্ডের এই বনাঞ্চল উজাড় করে ফেলে অসহায় হয়ে পড়ছে আশেপাশের গ্রামবাসী৷ শাহিন জানালেন, বন কাঁটার ফলে এই মুহূর্তে গ্রামবাসীর ক্ষতি না হলেও ভবিষ্যতে বসতি ছাড়তে বাধ্য হবেন তাঁরা৷ তিনি বলেন, ‘‘যখন শিপ ইয়ার্ডের বর্জ্য পরিবেশ নষ্ট করবে, একইসঙ্গে শব্দ দূষণসহ নানা দূষণ দেখা দেবে, তখন ঐ জায়গাটা পুরোপুরি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে৷''
শাহিনের এই বক্তব্যকে সমর্থন দিলেন আশেপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষরাও৷ ৭০ বছর বয়সী যতীন্দ্র জলদাস তাই বললেন, ‘‘তারা সব মাছ মেরে ফেলেছে, বন উজাড় করে দিয়েছে৷ এখন শুধু আমাদের তাড়ানোই বাকি৷''
কিন্তু সুধীজনের জিজ্ঞাসা, পরিবেশের শত্রুদের থামাতে বা আইনকানুনের মধ্যে আনতে সরকার কি উদ্যোগ নেবে না ?
প্রতিবেদন: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন