সীমান্তে হত্যা বন্ধে নেই কোনো উদ্যোগ
২৮ এপ্রিল ২০১৯মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই বিভিন্ন এলাকায় বিএসএফের গুলিতে ১১ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন৷ অথচ গতবছর সংখ্যাটি ছিল ৮ জন৷
সীমান্তে হত্যাগুলোর মধ্যে দুয়েকটি বাদে সবগুলোর পেছনে গরু চোলাচালানের বিষয়টিকে কারণ হিসাবে উল্লেখ করে আসছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী৷ তবে কোনো ধরনের অনুসন্ধান ছাড়া ‘নির্বিচারের' এই হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করছেন মানবাধিকার কর্মীরা৷
সীমান্তে হত্যা বন্ধে দু'দেশের সমন্বিত উদ্যোগের পরামর্শ দিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, ‘‘এতগুলো মানুষ যখন হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, তখন উদ্যোগতো নিতেই হবে৷ এটা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়৷ আমরাতো মনে করি, দু'পক্ষীয় আলোচনা হওয়া উচিত৷
‘‘কোনো কারণে যদি হত্যাকাণ্ড হয়, সেই সমস্যাগুলো নিবারণ করার উদ্যোগ নিতে হবে দুই পক্ষকেই৷ এটাতো কারোর একার ব্যাপার না৷ আমাদের মানুষ মারা যাচ্ছে, ওরা মারছে, ইন-বিটুইন নিশ্চয় কোনো গ্যাপ আছে, ইনফরেমশন গ্যাপ আছে- এই গ্যাপটা জানা উচিত এবং নিরীহ মানুষের মৃত্যুটা বন্ধ করা উচিত৷''
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া পার হতে গিয়ে বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হয় কিশোরী ফেলানী৷ কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর লাশ ঝুলে ছিল চার ঘণ্টা৷ আর ওই লাশের ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে তখন নিন্দার ঝড় ওঠে৷
বিএসএফের ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে ফেলানী নিহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হলেও বিএসএফ-এর বিশেষ আদালত তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে৷ আদালত তাঁর গুলি করাকে ‘যথার্থ' বলে মনে করেছে৷ একই আদালত রায় পুনর্বিবেচনা করে ২০১৪ সালের ২২শে ডিসেম্বর অমিয় ঘোষের খালাস বহাল রাখে৷
এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ এবাং ২০১৫ সালে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টে দু'টি রিট আবেদন করে সেখানকার মানবাধিকার সংগঠন৷ দীর্ঘ বিতর্কের পর দু'টি রিটই একসঙ্গে চলতে পারে বলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছে৷ এখন সুপ্রিম কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে ফেলানী হত্যা মামলা৷ সন্তান হত্যার বিচারের আশায় এখনো দিন গুণছেন ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম৷
চার মাসেই অন্তত ১১ হত্যা
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সীমান্তে হত্যার তথ্য সংগ্রহের কাজ করে থাকে মানবাধিকার সংগঠক আসক৷ তাদের হিসাবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই বিএসএফের গুলিতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১টি৷ সীমান্ত এলাকায় শারীরিক নির্যাতন ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২২টি৷
আগের বছরের সঙ্গে এ বছরের তুলনা করে আসকের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, ‘‘চার মাসে যেভাবে বেড়েছে... আমরা গতবার দেখেছি, গুলিতে হত্যা, অন্য ধরনের মৃত্যু, শারীরিক নির্যাতন, অপহরণ- এসব কিছু মিলিয়ে প্রায় ৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন৷ এবার এসে আমরা চার মাসেই দেখছি, ২২ জন অলরেডি এই কাতারে আছে৷ এটা বেশ অ্যালার্মিং বিষয়৷''
এপ্রিলের ১ তারিখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হন৷ এরপর ২২ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বাংলাদেশি তরুণকে হত্যা করে লাশ নিয়ে যায় বিএসএফ৷ পরে বিএসএফ-বিজিবি পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাঁর মরদেহ ফেরত আনা হয়৷
১ এপ্রিল নিহতের একজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনারল ইসলাম৷ সীমান্তে গরু আনতে গেলে বিএসএফের গুলিতে তিনি নিহত হন বলে জানিয়েছেন সোনারলের ভাই এনামুল হক৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাতে সীমান্তে দেখলেই গুলি করে বিএসএফ৷ আমার ভাইও রাখাল হিসাবে কাজ করতো, সে গুলিতে মারা গিয়েছে৷ এখন তো আমাদের কিছু করারও নাই৷''
গরু আনা-নেয়ার কাজ করে সোনারলের তিনজনের সংসার চলত বলে জানান তাঁর ভাই৷ তাঁকে হারিয়ে ছয় বছর বয়সি মেয়েকে নিয়ে এখন অথৈ সাগরে তাঁর স্ত্রী৷
সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা গরু চোরাচালানের বড় রুট হয়ে উঠলেও ‘অজানা কারণে' সেটা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না বলেও মনে করেন এনামুল৷
‘বিনা দোষে' ১১ বছর জেলে ফরাজী
দীর্ঘ ১০ বছর ভারতে কারাবাসের পর দেশে ফেরত আনা হয় বাদল ফারাজীকে৷ এরপর গত এক বছর ধরে এই ব্যক্তি বাংলাদেশের কারাগারে আছেন বলে জানান আসকের নির্বাহী পরিচালক শিপা৷
২০০৮ সালের ৬ মে নতুনদিল্লির অমর কলোনির এক বৃদ্ধা খুনের মামলায় বাদল সিং নামের এক আসামিকে খুঁজছিল ভারতের পুলিশ৷ ওই বছরের ১৩ জুলাই বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় বিএসএফ ভুল করে বাদল ফরাজীকে গ্রেপ্তার করে৷ ইংরেজি বা হিন্দি জানা না থাকায় তিনি বিএসএফ সদস্যদের নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি৷
১০ বছর ভারতের কারাগারে থাকার পর ২০১৮ সালের ৬ মে সরকারি উদ্যোগে ফারাজীকে দেশে ফেরত আনা হয়৷ এরপর তিনি বাংলাদেশের কারাগারেই আছেন৷ তাঁর ঘটনা বর্তমানে বাংলাদেশের আদালতে বিচারাধীন৷
নির্বিচারে বাংলাদেশিদের নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাদল ফরাজী উদাহরণ হয়ে আছে মন্তব্য করে শিপা হাফিজা বলেন, ‘‘ভিসা সহকারে, সম্পূর্ণ আইন মেনে ওপারে গিয়েছিল এবং তাঁকে জেলে নিয়ে নেয়া হয়৷ যেহেতু তাঁকে বলা হয়, সে ইলিগ্যালি ঢুকেছে৷ তারপর জেলে চলে গেলে যা হয়... এরপর তো কেউ দেখে না৷ কয়েক বছর যাবার পরে, যখন ওখানে আমাদের মতো মানবাধিকার সংগঠনেরা কাজ করলেন, প্রতিবাদ করলেন, তখন তারপর তাঁকে কিন্তু ইন্ডিয়ান কারাগার থেকে মুক্ত করা বা বাংলাদেশে চলে আসার ব্যবস্থা হয়৷ বাংলাদেশে যখন আসছে, তাঁকে আবার জেলে পোরা হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সে (বাদল ফরাজী) ভ্যালিড পাসপোর্ট-ভিসা নিয়েই ওপারে গিয়েছিল৷ কিন্তু তাঁকে জেল নেওয়া হয়েছে৷ এই রকমভাবে সবাই চোরাকারবারী করছিল বলে গুলি খেয়েছে, এটা আমরা বলতে পারি কি-না? মানুষের জীবন কি এত বেশি সহজ? এখানে আমরা ইনভেস্টিগেশন করব না?
‘‘নিশ্চয় বর্ডার গার্ডদের অনেক ক্ষমতা আছে, তারা গুলি না করেও কাউকে অ্যারেস্ট করতে পারে৷ আমাদের দাবি কিন্তু এটাই৷ এদেরকে সরাসরি গুলি করে মারলে মানবাধিকারে চূড়ান্ত লঙ্ঘন এই জন্যই হয় যে, কারণ না জেনেই আমরা মারি৷ আমরা কোনো ইনভেস্টিগেশন করলাম না, সে হয়তো লিগ্যাল ছিল৷ কিন্তু তাঁকে আমরা গুলি করে হত্যা করে দিচ্ছি৷''
নির্যাতনের শিকার আরেকজনকে ভারতীয় হাই কমিশন চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল জানিয়ে এই মানবাধিকার সংগঠক বলেন, ‘‘একটা ছেলেকে প্লাস্টিকের গুলি মারা হয়েছিল৷ যা তাঁর মুখে পড়ে৷ আমাদের অ্যাডভোকেসির কারণ ভারতীয় দূতাবাস তাকে ট্রিটমেন্ট দিয়েছে৷ ওকে বেশ কয়েকবার নিয়ে গেছে ওরা, ভারতে ট্রিটমেন্ট দিয়েছে৷ এখনো ট্রিটমেন্ট দিয়ে যাচ্ছে৷
‘‘এগুলো যখন হয়, তারা বলছিলেন, এগুলো হয়তো অনেক সময় মানুষজন আসা-যাওয়া যখন করে বর্ডারে, উনারা ঠিক টের পায় না, কে লিগ্যালি যায়, আর কে ইলিগ্যালি যায়৷ এসব সময়ে গুলিগোলাটা বেশি হয়৷ আবার যেহেতু গরুর একটা বিষয় আছে, এপার-ওপারে আসা-যাওয়ার, সেখানে মিসআন্ডারস্টান্ডিংয়ে গুলি কিংবা হত্যা অনেক বেশি হয়৷''