1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হাসিনা সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাইডেন প্রশাসন

ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম৷
আরাফাতুল ইসলাম
১৯ জানুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশের রাজনীতি এক নাটকীয় মোড় নিয়েছিল ২৮ অক্টোবর৷ সেদিন ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়, নির্বাচন কেমন হবে পরিষ্কার হয়ে যায়৷

https://p.dw.com/p/4bSiv
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
বাংলাদেশের নির্বাচন 'মুক্ত ও সুষ্ঠু' হয়নি বলে প্রতিক্রিয়া জানানোর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, এ নিয়ে রয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা

 তখন থেকে পশ্চিমা কূটনীতিকদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণেও চোখে পড়ে লক্ষণীয় নীরবতা৷

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে গত কয়েকবছর ধরে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে৷ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় একক বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ অন্যদিকে মার্কিন বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে৷

অর্থের হিসেবে ২০২২ সালে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য৷ দুই দেশের মধ্যে এমন বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের৷

বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগ করা দেশগুলোর মধ্যেও অন্যতম পশ্চিমা এই দেশটি৷ ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে ৫৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বর্তমান বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় হিস্যা এই দেশের৷ 

বিনিয়োগের পাশাপাশি নানাভাবে উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমেও ঢাকাকে এগিয়ে নিচ্ছে ওয়াশিংটন৷ এক্ষেত্রে এক উদাহরণ করোনা টিকা৷ যে টিকা শত শত কোটি টাকা খরচ করে ভারত, চীনের কাছ থেকে কিনতে চেয়েও সময়মতো বা প্রয়োজন মতো পায়নি বাংলাদেশ, সেই টিকা বিনামূল্যে পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে৷

করোনা মহামারি থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে বেশ কয়েক কোটি মার্কিন করোনা টিকা৷ বিশ্বের অন্য কোনো দেশকে এত পরিমান টিকা দান করেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যতটা দিয়েছে বাংলাদেশকে৷

মার্কিন উদ্বেগ, নিষেধাজ্ঞা

দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের আরেকটি দিক হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতার পশ্চাদপসরণ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ৷ এক্ষেত্রে গত তিন বছরে দুটো বড় শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন৷ প্রথমটি ব়্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা, দ্বিতীয়টি সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা প্রদানকারী যেকাউকে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার ঘোষণা৷

মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ব়্যাব এবং এর কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা অভাবনীয় ফলে বয়ে এনেছে৷ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে৷ দীর্ঘ সময়ের জন্য গুমের ঘটনাও বলতে গেলে ঘটছে না৷ বরং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে ধরে নিয়ে গেলে কয়েকদিনের মধ্যেই তার হদিশ মিলছে৷ সেই নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হওয়ার পর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে আবার বড় আকারে রাজপথে সক্রিয় হতেও দেখা গেছে৷

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিচার বিভাগকে বেশ সক্রিয় দেখা গেছে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের ‘রাজনৈতিক মামলায়' কারাবন্দি করে রাখতে ও সাজা নিশ্চিত করতে৷ এক্ষেত্রে অনেক সময় ‘সাজানো' ও ‘গায়েবী মামলা' ব্যবহার হচ্ছে বলেও জানিয়েছে ঢাকার সংবাদমাধ্যম৷

ভিসা নিষেধাজ্ঞা পালে হাওয়া পাচ্ছে না

আপাত দৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় পদক্ষেপ, মানে পরিচয় প্রকাশ না করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রদানের উদ্যোগ, পালে হাওয়া পেয়েছে বলে মনে হয়নি৷ যদিও গত মে মাসে ঘোষণা দেয়ার পর সেপ্টেম্বরে সেটি প্রয়োগও শুরু হয়েছে৷

কিন্তু দেখা গেল ২৮ অক্টোবর পুলিশের বাধায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর সক্রিয় প্রায় সব শীর্ষনেতাসহ দলটির বিশ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হলেন৷ সেদিন সহিংসতার ঘটনায় একাধিক প্রাণহানি হয়েছিল৷ কিন্তু কারা তা করেছে সেই তদন্তের আগেই ঢালাওভাবে বিএনপির ছোট-বড় নেতা-কর্মীদের নতুন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷

পাশাপাশি পুরনো মামলায় অনেকের অভাবনীয় দ্রুতগতিতে সাজা হয়েছে৷ বিএনপির কয়েকজন কারাগারে মারা গেছেন৷

জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলকে এভাবে আইনের আওতায় আনার মাধ্যমে বিচার বিভাগের রাজনৈতিক ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷ কিন্তু মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, যার মধ্যে বিচারবিভাগও অন্তর্ভূক্ত হতে পারে বলে অতীতে বলা হয়েছিল, কোনো প্রয়োগ এক্ষেত্রে দেখা গেল না৷

এটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে এজন্য যে, জুলাই মাসে যখন ঢাকায় বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে বেধড়ক পেটানো হয়, সেই ঘটনার কিছুদিন পর মার্কিনিদের তরফ থেকে যাদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে পুলিশও ছিল৷   

এমনকি ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে বিশ্বের কয়েকটি দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলেও বাংলাদেশের কোনো ঘটনা সেখানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি৷ মার্কিন এই নীরবতাও অনেককে বিস্মিত করেছে৷

আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ

সাত জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হয়েছে সেটা সবারই জানা৷ যা ঘটেছে সবার চোখের সামনেই ঘটেছে৷ এখন সেটাকে ‘চৈনিক গণতন্ত্র' বা ‘স্বৈরাচারী নির্বাচন' যা-ই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে পুরো সংসদ কার্যত আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে৷ এটা এক অভাবনীয় পরিস্থিতি, যা পশ্চিমারা যে গণতন্ত্রের কথা বলে তার পুরোই উল্টো চিত্র৷

শেখ হাসিনা সরকারকে যে দলটি চ্যালেঞ্জ করতে পারতো, সেই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ সক্রিয় সব নেতা-কর্মীকে জেলে রেখে এই নির্বাচনটি করা হয়েছে৷ বিশ্বের কোনো দেশের কাছেই বিষয়টি অজানা নয়৷

বিএনপি চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, কিন্তু সেক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি ক্ষমতাসীনরা৷ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরির আগ্রহও দেখা যায়নি৷ ফলে দমন-পীড়নের মুখে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় ‘অহিংস আন্দোলনে' থাকা বিএনপিসহ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ৬৩টি রাজনৈতিক দল৷    

সাত জানুয়ারির নির্বাচনের পর এখন এটা পরিষ্কার যে, বিএনপি বা বিরোধী জোটকে আর প্রতিপক্ষ মনে করছে না নতুন সরকার৷ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে হচ্ছে বাইডেন প্রশাসন৷ টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব শুরু করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের বক্তব্যেই সেই ইঙ্গিত মিলছে বারবার৷

 সর্বশেষ টুঙ্গিপাড়ায় তিনি বলেছেন, ‘‘অ্যামেরিকার লজ্জা নেই, তারা কখন কাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে তার ঠিক নেই৷''

মার্কিন নীরবতা কি ভাঙবে?

এদিকে, সাত জানুয়ারির পর দেয়া বিবৃতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছে যে নির্বাচন ‘অবাধ, বা সুষ্ঠু হয়নি'৷ পাশাপাশি এই বার্তাও দিয়েছে যে দুই দেশের ‘জনগণের সাথে জনগণের' সম্পর্কের দিকে গুরুত্ব দেবে যুক্তরাষ্ট্র৷

কিন্তু যেটা দেখার বিষয় সেটা হচ্ছে, মার্কিন বিবেচনায় অবাধ, বা সুষ্ঠু নির্বাচন না করে আবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷

অনেকেরই মনে থাকার কথা, নির্বাচনের বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই বাইডেন প্রশাসনকে বাংলাদেশ ইস্যুতে বেশ সক্রিয় দেখা গেছে৷ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতার পাশাপাশি দুর্নীতি, অর্থপাচার, শ্রম অধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের তৎপরতা ছিল বেশ লক্ষ্যণীয়৷ মার্কিন সরকারের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধিও ঢাকা সফর করেছেন তখন৷

কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বাইডেন প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণেরক্ষেত্রে যে দৃশ্যত নীরব নীতি নিয়েছে সেটা বেশ অস্বস্তিকর মনে হতে পারে৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, মার্কিন এই নীরবতা ভাঙতে পারে বড় কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণার মাধ্যমে৷

তবে এই নীরবতা যদি স্থায়ী রূপ পায়, সেটা হবে শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য৷ এমন সাফল্য, যা দেশে-বিদেশে তাকে পুরোপুরি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নিয়ে যাবে, তার ফলাফল কী হবে এখনই বলা মুশকিল৷

কিন্তু মার্কিনিরা দীর্ঘমেয়াদে আসলেই এমন নীরব থাকবেন কিনা তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে৷ কোন দিক দিয়ে তারা নীরবতা ভাঙতে শুরু করবে সেটা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে বেশ অস্বস্তি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷

আপাত দৃষ্টিতে এটাও মনে হতে পারে, ভারত, চীন ও রাশিয়া সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে বাংলাদেশকে সহায়তা করা এসব দেশের পক্ষে সম্ভব নয়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়, কিন্তু ভারত, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে আমদানি এবং ঋণ করতে হয় অনেক বেশি, রপ্তানি বা উন্নয়ন সহায়তা সে তুলনায় নগণ্য৷

ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ভারত, চীন বা রাশিয়ামুখী হতে চাইলে বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে অনেক শক্তিশালী হতে হবে৷ সেই অবস্থায় বাংলাদেশ নেই৷ বাংলাদেশের এত প্রাকৃতিক সম্পদও নেই যা দিয়ে এই বলয়ের প্রকৃত সহায়তা ধরে রাখতে পারবে দেশটি৷

বরং মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সংকট, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও সর্বোপরি অর্থনৈতিক মন্দা সামলানো এখন নতুন সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ৷ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মার্কিন ও পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে বাংলাদেশের৷

দেখার বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা পারদর্শিতা দেখাতে পারে নতুন সরকার৷