1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হিংসা কেড়ে নিয়েছে সব কিছু, বেঁচে আছে মনুষ্যত্ব

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি | স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে। ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হয়েছে উত্তর পূর্ব দিল্লির এক বিস্তীর্ণ এলাকা। ধ্বংসস্তূপের ভিতরে এখনও বেঁচে আছে মনুষ্যত্ব।

https://p.dw.com/p/3YZcV
ছবি: DW/S. Ghosh

ছাই হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হন্যে হয়ে কিছু খুঁজছিলেন তিনি। যদি কিছু পাওয়া যায়। কখনও বের করে আনছিলেন পুড়ে ঝামা হয়ে যাওয়া স্টিলের গ্লাস। দোমড়ানো-মোচড়ানো দু'একটা থালা।

গৌরীর চায়ের দোকান, ঘর-গেরস্থালি সবই ছিল পাঁচিল লাগোয়া ঝুপড়িতে। প্লাস্টিকের শিট, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে বানানো গরিবের অস্থায়ী আস্তানা। একপাশে চায়ের দোকান, অন্য পাশে দিন আনি দিন খাইয়ের সংসার। রাজস্থান থেকে আসা গৌরীর সম্পত্তি বলতে ছিল একটা ঘোড়ার গাড়ি। রাজস্থানী কাঠের কাজে সুসজ্জিত। যার খোলসটাই কেবল পড়ে আছে এখন। বাকিটা চলে গিয়েছে হিংসার গ্রাসে। উত্তর পূর্ব দিল্লির হিংসা ও আগুন পুড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু। ঘটনার তিন দিন বাদে আস্তানায় ফিরে এসে পোড়া সংসার, পোড়া দোকান হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন গৌরী। যদি কিছু পাওয়া যায়। খুঁজতে খুঁজতে তাঁর হাতে উঠে এল দু'টো গ্লাস। জলে ভরে গেল চোখ। ধরা গলায় সাংবাদিকের কাছে গৌরীর প্রশ্ন, ''আমার চায়ের দোকানে তো হিন্দু, মুসলিম সকলেই আসতেন। চা খেতেন, খাবার খেতেন, আড্ডা মারতেন। কে এই কাজ করল বলুন তো? কেন করল?''

একটু দূরেই পোড়া বাড়ি থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। রাস্তার মোড়ে স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে পোড়া অটো, গাড়ি, মোটর সাইকেল, টেম্পোর স্তূপ। পাশে একটি বড় গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানির গ্যারাজ পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। সেখানে সারি সারি গাড়ির কঙ্কাল। চারদিকে ধ্বসের চিহ্ন।  তার মধ্যেই নিজের যথাসর্বস্ব হারিয়ে গৌরী খুঁজে যাচ্ছেন, যদি কিছু পাওয়া যায়। রাজস্থানের গ্রাম ছেড়ে দিল্লিতে এসেছিলেন রুটি-রুজির জন্য। নিজের চেষ্টায় তৈরি চায়ের দোকান থেকে গ্রাসাচ্ছাদন হচ্ছিল। অদূরে বসে থাকা দু'টি বাচ্চা ছেলেমেয়েকে দেখিয়ে গৌরীর হাহাকার, ''ওরা তো কাল থেকে কার্যত অভুক্ত। কী করে ওদের মুখে খাাবার তুলে দেব?'' যিনি সামান্য পয়সার বিনিময়ে লোকের চা-তৃষ্ণা মেটাতেন, তুলে দিতেন দু'টো বিস্কিট বা টোস্ট, সেই সামান্য আয় থেকে রাতে রুটি ও সবজি উঠত বাচ্চাদের মুখে, তাঁর সেই সম্বলটাও গেল। হিংসা কেড়ে নিল সব কিছু।

গৌরীর দু'চোখে শূন্যতা। কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিচ্ছু জানেন না। একটাই কথা আওড়ে গেলেন কেবল, লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে গেল। বেঁচে থাকার লড়াই। জানেন না, উত্তর পূর্ব দিল্লিতেই থাকবেন, না কি এক বুক যন্ত্রণা সম্বল করে ফিরে যাবেন রাজস্থান।

গৌরীর আস্তানা চমন পার্কের একদিকে। মাঝে ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে কালো জলের খাল। ও পারে মুসলিম মহল্লা। মাঝের ওই খালটা এখন কার্যত সীমান্তের চেহারা নিয়েছে। এ পারের লোক ও পারে যাচ্ছেন না। ও পারের লোক এ পারে। কিন্তু প্রশ্নের কোনও সীমান্ত হয় না। গৌরীর কথার অনুরণনই ভাসছে ও পারের মহল্লায়।

উল্টোদিকে শিববিহার। সেখানেই ছয় নম্বর গলিতে মহম্মদ সেলিমের বাড়ি ছিল। নিচে দোকান। সেই দোকানের এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। বাড়ির কী অবস্থা, জানেন না সেলিম। সর্বস্বান্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন চমন পার্কের একটি অস্থায়ী আশ্রয়ে। মাঝে মাঝে রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভয়ে খাল পেরতে পারছেন না। সাংবাদিকদের কাছে সেলিমের কাতর আবেদন, ''একবার দেখে আসুন না বাড়িটা। আপনাদের যেতে দেবে। পুলিশ থাকবে।'' অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে পাগলের মতো পায়চারি করে যাচ্ছেন সেলিম।

তবে এই ধ্বংস, আগুন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সাধারণ মানুষের অপার কষ্টের মাঝখানে মরুদ্যানের দৃশ্যও আছে। বেঁচে আছে মনুষ্যত্ব। মুসলিম অধ্যুষিত চমনপার্কেই রয়েছে একটি শতাব্দী প্রাচীন মন্দির। যা আগলে জীবনপণ করে বসে আছেন হাজি জাহির আহমেদ ও মহল্লার লোকেরা। মন্দিরের গায়ে আঁচড় লাগতে দিচ্ছেন না তাঁরা। পালা করে রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছেনৃ। হাজি জাহির আহমেদের সোজা কথা, ''যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন মন্দিরের গায়ে আঁচড় লাগতে দেব না। আমরা পালা করে রাত জাগি। গোটা মহল্লার লোক সজাগ। কয়েকটি হিন্দু পরিবারও আছে এখানে। তাদের সুরক্ষাও আমাদের দায়িত্ব। আমাদের প্রাণ থাকতে ওদের কিচ্ছু হবে না।'' চতুর্দিকের ধ্বংসের আবহে হাজি সাহেবের কথাগুলো ফিনিক্স পাখির মতো। বোঝা যায়, সব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয় না।