1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিভারত

১৭ দফা অনিয়মের শিকার হলেন যোগ্য প্রার্থীরাও

২৩ এপ্রিল ২০২৪

নিয়োগ দুর্নীতিতে সামনে এসেছে ১৭ দফা অনিয়ম। যোগ্য-অযোগ্য সব নিয়োগই বাতিল করে দিয়েছে আদালত।

https://p.dw.com/p/4f5ch
কলকাতা হাইকোর্ট ভবন।
নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ১৭টি অনিয়মের কথা বলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। ছবি: Jagannath Raul/Dinodia/IMAGO

২০১৬ সালের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের প্যানেল সোমবার বাতিল করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি গিয়েছে। এই মামলার রায়ে নানা অনিয়মের কথা উল্লেখ করেছেন বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদি।

অনিয়মের ১৭ দফা

নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগে বহু মামলা দায়ের হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে। বিভিন্ন সময় একাধিক বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে নিয়োগের ক্ষেত্রে। চূড়ান্ত রায়ের তারই প্রতিফলন দেখা গেল।

আদালত রায়ে বলেছে, শূন্যপদের থেকে বেশি সংখ্যায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কমিশন যতজনের চাকরি মঞ্জুর করেছে, তার থেকে বেশিজন নিয়োগ পেয়েছেন। চাকরি দেয়া হয়েছে প্যানেলের বাইরে থেকেও। অনেক প্রার্থী সাদা খাতা জমা দিয়েও নিয়োগ পেয়েছেন। 

যে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে, সেই প্যানেল থেকে নিয়োগ করা হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা তালিকার ক্রম অনুসরণ করা হয়নি। অর্থাৎ তালিকার উপরের দিকে থাকা প্রার্থীর বদলে অনেক পিছনে থাকা প্রার্থীকে চাকরি দেয়া হয়েছে। প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও সেখান থেকে কাউন্সিলিং করে নিয়োগ করা হয়েছে।

হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাদের রায় বলেছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি। যাদের বেআইনিভাবে চাকরি দেয়া হয়েছে, সেই প্রার্থীদের রাজ্য সরকার, স্কুল সার্ভিস কমিশন ও পর্ষদ চিহ্নিত করতে পারেনি। বেআইনিভাবে নিযুক্ত প্রার্থীদের চাকরি টিকিয়ে রাখতে, অতিরিক্ত পদ তৈরির আবেদন করেছে কমিশন।

লক্ষ লক্ষ উত্তরপত্র বা ওএমআর শিট ফের মূল্যায়নের কথা বলেছেন বিচারপতিরা। নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে এই উত্তরপত্রের জালিয়াতির বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আদালতের মত।

উত্তরপত্র স্ক্যান করার দায়িত্ব দেয়া হয় নাইসা নামের একটি সংস্থাকে। তারা সেই দায়িত্ব দেয় ডেটা স্ক্যানটেক বলে আর একটি সংস্থাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার বদলে অন্য সংস্থা চূড়ান্ত গোপন একটি কাজ পরিচালনা করে। এসএসসির দাবি, তারা ডেটা স্ক্যানটেক বলে কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়নি।

উত্তরপত্র সংক্রান্ত নথিপত্র কমিশন নষ্ট করে ফেলে। এক্ষেত্রে তাদের সার্ভারে উত্তরপত্রের স্ক্যান করা প্রতিলিপি তদন্তকারী সংস্থা খুঁজে পায়নি। স্ক্যান করা কপি সার্ভারে না রেখেই মূল উত্তরপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। তথ্যের অধিকার আইনে অনেকে উত্তরপত্র নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নকারীদের ওএমআর শিটের স্ক্যানড কপি দেয় কমিশন।

যোগ্যদের চাকরি

২০১৬ সালের নিয়োগ প্যানেল ত্রুটিপূর্ণ, এমনটাই মনে করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু যত নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ, তার প্রায় চারগুণ বেশি যোগ্য প্রার্থী কাজ হারিয়েছেন। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ্যতার সঙ্গে চাকরি পেয়েছেন তাদের চাকরি কেন গেল, এই প্রশ্ন উঠছে।

এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদারের বক্তব্য, ''হাজার পাঁচেক প্রার্থীর চাকরি নিয়ে প্রশ্ন ছিল তাহলে বাকি ১৯ হাজার নিয়োগপ্রাপ্তের চাকরি কেন গেল, তা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানাব।''

একই সুরে রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, ''যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি কেন বাতিল করা হল, সেটা রাজ্যবাসী জানতে চাইছেন। কমিশন উচ্চ আদালতে আবেদন জানালে রাজ্য পূর্ণ সহযোগিতা করবে।''

ডিভিশন বেঞ্চ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছে, এমন ভাবে দুর্নীতি সংগঠিত করা হয়েছে যে যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। পুরো প্যানেল বাতিল না করলে অযোগ্যদের বরখাস্ত করা যেত না বলে মত বিচারপতিদের।

যারা যোগ্য, তারা আবার নয়া প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ পেতে পারেন। নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আদালত সময় বেঁধে দিয়েছে কমিশনকে।

শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ''অযোগ্যদের চিহ্নিত করতে এসএসসি বা রাজ্য প্রশাসন অসহযোগিতা করলে, আইনের মাধ্যমে তাদের বাধ্য করা যেত। এসএসসি ও সরকারের অপদার্থতার দায়ে যোগ্য-অযোগ্যদের এক করে দেওয়া হবে কেন?''

‘দুর্নীতি খুবই ব্যাপক, তাই বোঝা মুশকিল কে যোগ্য কে অযোগ্য’

বিকৃতির কৌশল?

সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে, পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র বিকৃত করা হয়েছে। ওএমআর শিট  নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। তার স্ক্যান করা কপিও পাওয়া যাচ্ছে না। এইসব নথি এসএসসির কাছে নেই। যদি উত্তরপত্র না থাকে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করা সম্ভব?

উত্তরপত্র স্ক্যান করার সময় পরিকল্পিতভাবে তা বিকৃত করা হয়েছে বলে তদন্তকারীদের দাবি। এই স্ক্যান করার প্রক্রিয়া যে সংস্থা কমিশন অফিসে বসে চালিয়েছে, তার কথা এসএসসি চেয়ারম্যান জানেন না বলে দাবি করেছেন। এই দাবিতে আরো ঘনীভূত হয়েছে বিকৃতি ও তথ্য লোপাটের আশঙ্কা। 

যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের যাতে আলাদা করে চিহ্নিত করার সুযোগ না থাকে সে কারণেই ওএমআর শিট বিকৃত বা নষ্ট করা হয়েছে বলে আদালতে দাবি জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা।

কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত বলেন, ''উত্তরপত্র বিকৃত করা হয়েছে। সেখান থেকে কী তথ্য পাওয়া যায়, দেখতে হবে। যদি বিকৃতির ফলে তথ্য না মেলে, তা হলে যোগ্য ও অযোগ্যদের মধ্যে ফারাক করা যাবে না।''

বাম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ''গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই কলঙ্কিত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের চাকরি বাতিল হয়েছে। দুর্নীতি যখন এতো ব্যাপক হয়, তখন বোঝা মুশকিল কে যোগ্য আর কে অযোগ্য।''

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একে 'বিজেপির কথায় রায়' তকমা দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তৃণমূল সাংসদ ও আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমান, এই রায় সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করে দেবে। ভারতে লোকসভা ভোটের মরশুমে এসব নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর তুঙ্গে উঠেছে। 

অযোগ্যদের পদে বহাল রাখতে রাজ্য মন্ত্রিসভা 'সুপার নিউমেরিক' বা অতিরিক্ত পদ তৈরি করেছিল। যারা এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ছিলেন, তাদের প্রয়োজনে হেফাজতে নিয়ে তদন্তের কথাও বলেছেন বিচারপতিরা।

স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে যে প্রার্থীরা মাসের পর মাস অবস্থান আন্দোলন করছেন, তারা হাল ছাড়ছেন না। আবার যোগ্যতা প্রমাণে তারা রাজি। কিন্তু জীবনের আটটা বছর কে তাদের ফিরিয়ে দেবে, এই প্রশ্ন অনেকে তুলছেন। তাতে অবশ্য লড়াইয়ের ইচ্ছেটা মরেনি।

আদালতের নির্দেশে সাত মাস আগে চাকরি পেয়েছিলেন প্রিয়াংকা সাউ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি স্কুলে শিক্ষক পদে যোগ দেন তিনি। মঙ্গলবারের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন প্রিয়াংকা। তিনি বলেন, ''অযোগ্যদের বাদ দিতে গেলে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হবে। এই সহযোগিতা আমাদের করা দরকার, যাতে অযোগ্যদের একেবারে ছুড়ে ফেলা যায়।''

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷