1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘২৫শে মার্চের সেই রাত...’

২৩ মার্চ ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনই কেড়ে নিয়েছে বহু বুদ্ধিজীবী, আত্মার আত্মীয়দের৷ বহু নারী হয়েছেন স্বামী, সন্তান হারা৷ অনেকের কাছেই যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে উঠেছে এক তমসাচ্ছন্ন রাত্রি৷

https://p.dw.com/p/12eo2
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ফুল দিচ্ছে একটা বাচ্চা
ছবি: AP

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক৷ দেশের ভেতরে ও বাইরে শরণার্থী ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা, চাঁদা তোলা, ওষুধ, খাবার, কাপড় সংগ্রহ করা, ক্যাম্পে ক্যাম্পে রান্না করা, সেবা করা, চিকিৎসা করা, অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবে কাজ করা, এমনকি সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার কাজেও অংশ নিয়েছিলেন বহু নারী৷ শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা, মুক্তির গানের শিল্পীরা গানের মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে জাগিয়ে তুলেছিলেন দেশের ভেতরের অবরুদ্ধ, পীড়িত, নির্যাতিত নারী-পুরুষকে৷ আজ মুক্তিযোদ্ধাদের জবানি পড়লে বোঝা যায়, নারীদের সাহায্য ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ চালানো দূরূহ হয়ে উঠতো৷

কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা, তাঁর সংগ্রাম তো শুধু প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষভাবেও ছিল৷ তাঁরা নির্যাতিত, নিগৃহীত হয়েছেন৷ আবার কখনও মুখ বন্ধ করে তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে স্বজন হারানোর স্মৃতি, যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজ অধিকারের জন্য৷ ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঠিক যেমনটি ঘটেছিল বাংলাদেশের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ'-এর নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতার জীবনে৷ সেই রাতের কথা মনে করলে, সবকিছু ছাপিয়ে আজও মেঘনার মনে পড়ে হানাদার বাহিনীর পায়ের শব্দ, গোলা-গুলির ভীতিকর আওয়াজ৷

মেঘনা গুহঠাকুরতা তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী৷ অধ্যাপক বাবা ও স্কুল শিক্ষিকা মাকে ঘিরে সুখি এক পরিবার৷ অথচ একাত্তরের মার্চ মাসের সেই কালো রাত তাঁদের জীবনটাকে একেবারে উল্টে-পাল্টে দিলো৷

চিরদিনের মতো পিতৃহারা হলেন মেঘনা

মেঘনা বললেন, ‘‘আমার বাবা ছিলেন ইংরেজি ভাষার শিক্ষক৷ তিনি খাতা দেখছিলেন সেই রাতে৷ আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ আর মা বাড়িতেই অন্য একটা ঘরে ছিলেন৷ হঠাৎ করে প্রচণ্ড গোলা-গুলির শব্দ শোনা গেলে, আমায় জাগিয়ে তোলা হয়৷ এরপরই পাকিস্তানি সেনারা এসে হানা দেয় আমাদের বাড়িতে৷ ধাক্কা দিয়ে, লাথি দিয়ে দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার উপক্রম করে৷ বাগান দিয়ে ঢোকে তিনজন সৈনিক এবং এসে তারা বাবাকে নিয়ে যায়৷ সে সময় যেহেতু শিক্ষকরা একটা অহযোগ আন্দোলন করছিলেন, তাই আমরা ভেবেছিলাম যে তারা বাবাকে ‘অ্যারেস্ট' করতে এসেছে৷ কিন্তু পর মুহূর্তেই আমারা বুঝতে পারলাম৷ না, অ্যারেস্ট নয়...তারা বাবাকে প্রথমে তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করে৷ বাবা তাঁর নাম বলেন৷ তারপর তাঁর ধর্ম কী – তা জিজ্ঞাসা করে৷ বাবা বলেন হিন্দু৷ এরপরই বাবাকে প্রথমে ওরা ঘাড়ে গুলি করে৷ তারপর দ্বিতীয় গুলিটা করে কোমরে৷ সঙ্গে সঙ্গে বাবা পড়ে যান৷''

মেঘনা গুহঠাকুরতার ছবি
মেঘনা গুহঠাকুরতা, শহিদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সন্তানছবি: DW/D. Guha

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভেতরে ভেতরে যেন আরও একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মেঘনা গুহঠাকুরতার পরিবারে৷ গুলিবিদ্ধ হয়েও বাবা জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কোয়ার্টারে ও ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়লেন কয়েক দিন৷ মারা গেলেন একরকম বিনা চিকিৎসায়৷ সেদিনের সে কথা মনে করে আজ মেঘনার ভাষ্য, ‘‘২৫শে মার্চের রাত্রি, ২৬শে মার্চের দিন এবং রাত – এই পুরো ২৪ ঘণ্টা আমরা বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি৷ কারণ, সে সময় কার্ফিউ চলছিল৷ টহলদার বাহিনী সবাই গুলি করছিল৷ পরে ২৭ তারিখের সকালে কার্ফিউ ভাঙার পর, আমরা রাস্তার কিছু সাধারণ মানুষকে ডেকে বলি বাবাকে উল্টো দিকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে৷ তখনও বাবা সচেতন এবং জীবিত৷ কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা জানান যে, ‘ক্রিটিকাল ইঞ্জুরি'-র কারণে আর কিছুই করা সম্ভব নয়৷''

Bangladesh Unabhängigkeitsbewegung Flash-Galerie
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে চলছে নানা উদ্যোগছবি: Public domain

মেঘনার জীবনে চিরদিনের জন্য এক দাগ থেকে গেলো

অর্থাৎ একটা ১৫-১৬ বছরের মেয়েকে ২৪ ঘণ্টারও বেশি একটা সময় আহত বাবার হাত ধরে বসে থাকতে হয়েছিল৷ একটা দেশে একদিকে যখন ভবিষ্যতের ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে ছোট্ট একটা মেয়ের জীবনে চিরদিনের জন্য দাগ কেটে যাচ্ছে সেই ইতিহাসের চরম বাস্তবতা৷ মেঘনার জানান, ‘‘আমি তখন কান্নাকাটি করছি৷ মাকে বলছি, মা তুমি দেওয়াল টপকিয়ে নার্সদের হোস্টেলে যাও৷ একজন নার্সকে নিয়ে এসো৷ বা স্বপ্ন দেখছি, ইস্ যদি একটা রেডক্রসের অ্যামবুলেন্স পাওয়া যেত – তাহলে বাবাকে তাদের হাতেই তুলে দিতাম৷ বাবা সুচিকিৎসা পান, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন৷ তখন সেটাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা৷ অথচ আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র বাবাই টের পেয়েছে যে ইতিহাস রচিত হচ্ছে৷ কারণ আহত অবস্থাতেই বাবা আমার মাকে ধরে বলেছিলেন, লেখো৷ মা বলছেন, কী লিখবো? বাবা বললেন, ইতিহাস৷ মা তখন বলেছিলেন, আমি যে ইতিহাস লিখতে পারি না৷ শুনে বাবা বলেছিলেন, তাহলে সাহিত্য লেখো৷ সেই কথার সূত্রেই ঐ ঘটনার প্রায় ২৫ বছর পর, মা একটি বই লিখেছিলেন ‘একাত্তরের স্মৃতি'৷''

সেই ঘটনায় মা বাসন্তী গুহঠাকুরতা হতোদ্যম হয়ে পড়লেন৷ সব দিকেই বিপদ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ৷ ঝুঁকি নিলেন অন্য রকমের৷ খ্রিষ্টান পরিচয় দিয়ে নিজে ভর্তি হলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আর মেয়ে মেঘনাকে রাখলেন ফার্মগেটের একটি অরফানেজে৷ এভাবেই পুরো নয় মাস বাঁচার জন্য নানা পরিচয়ে নানা জায়গায় যুদ্ধ করতে হয়েছে তাঁদের৷ মেঘনার কথায়, ‘‘বাবা মারা যান ৩০ তারিখে৷ আর তারপরেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হয় বাবাকে ওভাবে রেখেই৷ তখন আর্মি হাসপাতাল আক্রমণ করার ফলে, তাঁর মৃতদেহের সৎকার্য আমরা করতে পারিনি৷ সেই শুরু৷ এরপর ঢাকা শহরেই আমরা নয় মাস ছিলাম৷ বিভিন্ন মানুষের বাসায়, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রূপ নিয়ে থাকতে হয়েছিল আমাদের৷ মাঝেমাঝে পরিচয় গোপন করে থাতে হয়েছিল, বিশেষ করে আমার মাকে৷ আমি তখন হোলিক্রস স্কুলে পড়তাম৷ তাই কনভেন্টের বহু সিস্টার আমাদের চিনতেন৷ তাই তাঁদের কাছে গিয়েই আশ্রয় চাওয়া হয়েছিল৷ তাঁরা মাকে বিনা পয়সায় সেখানে আর আমাকে অরফানেজে রাখতে রাজি হন৷ তবে আমাকে খ্রিষ্টান হিসেবে থাকতে হয়েছিল৷ তখন হিন্দু ছেলে-মেয়েদের ওপর এক ধরনের আক্রমণ চলছিল৷ আর্মিরা এসে রেজিস্টারে রোল চেক করতো – কে হিন্দু, আর কে মুসলমান৷ তারপর বেছে বেছে নিয়ে যেত হিন্দুদের৷''

Unabhängikeitsfeier in Bangladesh
ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন অসংখ্য মানুষছবি: AP

বাবার মৃত্যু প্রমাণিত করতেই দেশে থেকে গেলেন মেঘনা

কিন্তু কেন? কেন তাঁরা চলে গেলেন না দেশ ছেড়ে? মেঘনা গুহঠাকুরতা জানান, ‘‘আমার মার স্থির বিশ্বাস ছিল যে আমরা যদি অন্যদের মতো ভারতে চলে যাই, তাহলে বাবার এই মৃত্যু প্রমাণিত হবে না৷ কারণ, মা যখন পরে হাসপাতালে বাবার ‘ডেথ সার্টিফিকেট নিতে যান, তখন দেখেন যে তাতে লেখা আছে – ‘ডেথ বাই নিউমোনিয়া'৷ প্রথমে কিন্তু বেডের ওপর ‘ডেথ বাই বুলেট ইঞ্জুরি' লেখা ছিল৷ মা যখন এ ব্যাপারে ডাক্তারদের প্রশ্ন করেন, ডাক্তাররা বলেন যে, ‘সত্য কথাটা আমরা এখন বলতে পারবো না৷ এখন আপনাকে এই ডেথ সার্টিফিকেটই নিতে হবে'৷ মা তখন আমায় বললেন, দ্যাখ, এই মৃত্যু যাতে প্রমাণিত হয় – এর জন্য আমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে৷ ইট ইস ডেথ বাই বুলেট ইঞ্জুরি৷ ইট ইস অ্যান এক্সিকিউশন৷''

জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতার মতো অসংখ্য মানুষকে হত্যা, বহু মানুষের ত্যাগ আর অদম্য আত্মবিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে৷ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সফল হয়েছে অচিরেই৷ কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের সেদিনের সেই সত্তাকে আমরা কি সত্যিই ধরে রাখতে পেরেছি? সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞের পরও কিন্তু আশাবাদী আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক মেঘনা গুহঠাকুরতা৷ তাঁর কথায়, ‘‘মুক্তিযুদ্ধকে আমি মনে করি ‘ফাউন্ডেশনাল'৷ ঐ ঘটনা-পরবর্তী জীবনে আমি শিক্ষক৷ আমি ২২ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি৷ আমি আমার ছাত্রদেরকে বুঝিয়েছি যে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে পরিচিতি দিয়েছে৷ বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছে৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি যে, আমাদের নতুন প্রজন্ম সে কথা ভোলেনি৷ যদিও একটা পর্যায়ে মনে হয়েছিল যে, আমাদের রাজনীতিবিদরা সে কথা ভুলে গেছে৷ আমি ‘প্রজন্ম একাত্তর' বলে একটি সংস্থার সদস্য, যাদের করা একটি পোস্টারের মধ্যে লেখা আছে – তোমরা যা বলেছিলে, বলছে কি তা বাংলাদেশ? এটা একটা প্রশ্ন করা৷ যাতে করে আমরা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়তে পারি৷ এটা একটা আশা জাগিয়ে তুলবে৷ আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ একটা ‘ইন্সপিরেশন'৷''

কেমন লাগলো আপনার এই শহিদ-কন্যার কাহিনি? জানান নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান