ভাগ্যিস সুনীল বেঁচে নেই! এবার সেই ক্রিকেট বিশ্বকাপ ছোট হয়ে ১০ দলের খেলা হয়ে গেছে৷ এই ঘটনা শুনলে তো ক্রিকেট বিশ্বকাপকে টুর্নামেন্ট বলেই মানতে চাইতেন না সুনীল৷ তবে এই ১০ দলের খেলা বলেই এবার অনন্য এক বিশ্বকাপ দেখতে চলেছি আমরা৷ গত কয়েক আসর ধরে বিশ্বকাপের যে অনিশ্চয়তা দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, সেটা শেষ হতে চলল৷ লিগভিত্তিক এই টুর্নামেন্ট এবার সত্যিই খুজে বের করবে ‘সেরা' দলকে৷ আর এ জন্যই মানতে হবে যে, এই ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে হতে চলেছে স্মরণকালের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ক্রিকেট বিশ্বকাপ৷
১৯৭৫ সালে ৮টি দলকে নিয়ে শুরু হয়েছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ৷ এর মধ্যে ৬টি ছিল আইসিসির পূর্ন সদস্য এবং বাকি দুটি সহযোগী সদস্য দেশ৷ তখন ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ এত কম ছিল যে, এটাই বেশ বড় আকারের টুর্নামেন্ট বলে বিবেচিত হয়েছিল৷ তা-ও কিন্তু সব দল সবার সাথে খেলেনি৷ ৮ দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করে হয়েছিল আয়োজন৷ ১৯৭৯ সালে ঠিক একই ফরম্যাটে আয়োজিত হয় দ্বিতীয় আসর৷ সবার সাথে সবার দেখা হলো না৷ ১৯৮৩ সালের তৃতীয় আসরেও ৮টি দল দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলল৷ ১৯৮৭ সালের চতুর্থ আসরেও দেখা গেল একই ঘটনা৷ ১৯৯২ সালে এসে প্রথম বিশ্বকাপের ফরম্যাট বদলায়৷
১৯৯২ বিশ্বকাপকে বলা যায় এবারের বিশ্বকাপের প্রকৃত পূর্বসুরী৷ সেবার বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ৯টি দল৷ সবার সাথে সবার খেলা হলো৷ এরপর সেরা চারটি দল সরাসরি খেলল সেমিফাইনাল৷ সেই সময়ই একটা প্রস্তাবনা ছিল যে, ক্রিকেট যেহেতু কম দেশের খেলা, এই ফরম্যাটটাই ধরে রাখা হোক৷ কিন্তু ১৯৯৬ সালে আবার ফরম্যাটে পরিবর্তন এলো৷
ততদিনে জগমোহন ডালমিয়াদের কল্যাণে ক্রিকেটের গায়ে বিশ্বায়নের বাতাস লেগেছে৷ ফলে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা মন্ত্র নিয়ে ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপের আসর বসলো দক্ষিণ এশিয়ার তিন টেস্ট খেলুড়ে দেশে৷ অংশগ্রহনকারী দেশের সংখ্যা এক লাফে বেড়ে হলো ১২৷ দুই গ্রুপে ৬টি করে দল খেললো৷ ফলে সবার সাথে সবার খেলার যে ধারা ১৯৯২ সালে দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে আবার সরে এলো বিশ্বকাপ৷ ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালে ১২ দলকে নিয়ে দুই গ্রুপের খেলা হলো৷ এরপর ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে দল বাড়লো আরো দুটো৷ ১৪ দল এবার দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে খেললো৷
২০০৭ সালে একেবারে আনকোরা, মোড়কভাঙা এক পদ্ধতির বিশ্বকাপ দেখলো ক্রিকেটবিশ্ব৷ ১৬ দলের টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজে৷ এবার ৪টি গ্রুপে অনুষ্ঠিত হলো খেলা৷ প্রত্যেক গ্রুপের সেরা দুই দল গেল পরের রাউন্ডে; নাম দেওয়া হলো-সুপার এইট৷ এই ‘সুপার এইট'-এর সব দল সবার সাথে খেললো৷ এখান থেকে সেরা ৪ দল গেল সেমিফাইনালে৷ সেটা ছিল ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিশ্বকাপ৷ বিশ্বায়নের পর্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বললেন, এটাই বিশ্বকাপের সেরা মডেল৷ কিন্তু এই মডেল থেকে সরে এলো আইসিসি৷
২০১১ সালে আবারও সেই ২০০৩ সালের ফরম্যাটে ফিরে গেল উপমহাদেশের বিশ্বকাপ৷ ১৪ দল দুই গ্রুপে অংশ নিলো৷ তবে এবার বাড়তি হিসেবে যোগ হলো কোয়ার্টার ফাইনাল৷ ২০১৫ সালে, মানে সর্বশেষ আসরটিতেও হলো এই একই ধরনের বিশ্বকাপ৷ কিন্তু ২০১৯ সালের জন্য আইসিসি হঠাত্ করে দলসংখ্যা কমিয়ে একেবারে নব্বই দশকের শুরুতে চলে গেল৷ আর ফরম্যাটও করা হলো রবিন লিগ পদ্ধতির৷
এখন ক্রিকেট বিশ্ব এই বিশ্বকাপ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত৷ এক দল মনে করেন, ক্রিকেটের মতো স্বল্প বিস্তৃত খেলার জন্য এটাই আদর্শ ফরম্যাট৷ কারণ, এখানে সবার সাথে সবার খেলা বলে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা কম৷ ফলে সত্যিকারের সেরা চারটি দলই সেমিফাইনালে যাবে৷
আবার ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যাঁরা কথা বলেন, তাঁরা বলেন, ক্রিকেটের সৌন্দর্যটাই এই ফরম্যাটের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে৷ অঘটন ঘটার সম্ভাবনা শেষ করে দেওয়াতে একটা আয়ারল্যান্ড বা জিম্বাবোয়ের উত্থান দেখা কঠিন হয়ে গেছে বিশ্বকাপে৷ ২০০৭ বা ২০১১ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড যেভাবে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল পাকিস্তান বা ইংল্যান্ডকে হারিয়ে, সেটা এবার আর দেখা যাবে না৷ শুধু আয়ারল্যান্ড কেন, জিম্বাবোয়ের মতো ক্রিকেটের পুরোনো দলও এবার রয়ে গেল বিশ্বকাপের বাইরে৷
শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটার তাই এই ফরম্যাটের সমালোচনা করেছেন৷
তবে সমালোচনা থাক আর প্রশংসা থাক; এটা মানতেই হবে যে, এই বিশ্বকাপ অন্য যে কোনো আসরের চেয়ে আলাদা হতে চলেছে৷ সেটা শুধু ফরম্যাটের জন্য, তা নয়৷ আরো কিছু বিচারের জায়গা আছে৷ এবার বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে অন্যরকম রান উত্সবের একটা বিশ্বকাপ হওয়ার কথা৷
ইংল্যান্ডে এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ হচ্ছে৷ প্রথম তিন বার বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল ইংলিশরা৷ তখন ইংল্যান্ড থেকে বিশ্বকাপকে বের করার জন্য এশিয়াভিত্তিক একটা রাজনৈতিক সক্রিয়তাও হয়েছিল, যার অংশ হিসেবেই জন্ম নিয়েছিল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল৷ এরপর আবর্তন নীতিতে বিশ্বকাপ আয়োজিত হতে থাকে৷ সেই নীতিতে ১৯৯৯ সালে আবারও বিশ্বকাপ হয়েছিল যুক্তরাজ্যে৷ কিন্তু এই ক্রিকেটের ‘মাতৃভূমিতে' কখনোই বিশ্বকাপ ঠিক রান উত্সবের আসর হয়ে ওঠেনি৷ এবার সেটা হওয়ার খুব সম্ভাবনা আছে৷
ইতিমধ্যে বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাজ্যে যেসব ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড, বাংলাদেশ রান উত্সব করছে৷ ফলে বিশ্বকাপেও যে সেটা হবে, তাতে খুব একটা সন্দেহ নেই৷
ইংল্যান্ড বলতে এক সময় মনে করা হতো বোলারদের খেলা৷ বিশেষ করে গ্রীষ্মের এই সময়ে সেখানে বল নড়াচড়া করবে, দারুণ সুইং থাকবে; এগুলোই সত্যি ছিল৷ কিন্তু ইংল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি আসার পর থেকে সেখানে উইকেটের সেই মজাটা চলে গেছে৷ এখন ইংল্যান্ডে টেস্টেও ব্যাটসম্যানদের খেলা হয়৷ ফলে ওয়ানডে এখন সেখানে রীতিমতো বোলারদের বধ্যভূমি৷
বিশ্বকাপে তিন শ রানটাই বিরাট ব্যাপার৷ কিন্তু এবার বিশ্বকাপে সাড়ে তিন শ' নিয়মিত স্কোর হয়ে উঠলেও তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷
তবে মজাটা হলো, সবটাই তো আর কিউরেটরের হাতে নেই৷ কিছুটা প্রকৃতির হাতেও আছে৷ এই সময়ে মাঝে মাঝেই ইংল্যান্ডের আকাশ ভারী হয়ে উঠবে৷ মেঘে ঢাকা আকাশে যতই বোলারদের বিরোধী উইকেট হোক, কিছুটা সুইং তো দেখা যাবেই৷ তাই ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষার জন্যই অপেক্ষা করা যাক৷
অপেক্ষা করা যাক সত্যিই অনন্য এক বিশ্বকাপের জন্য৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷