আংশিক লকডাউনে কি অতিমারির মোকাবিলা সম্ভব?
৮ মে ২০২১শহরতলির লোকাল ট্রেন মহানগরী কলকাতার লাইফলাইন৷ জেলা থেকে রোজ লক্ষ লক্ষ মানুষ হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে শহরে আসেন রুটি-রুজির জন্য৷ আসে কাঁচা সব্জি, মাছ-সহ অন্যান্য সামগ্রী৷ কোভিডের প্রথম ঢেউ সামলাতে প্রথম দফায় আট মাস বন্ধ ছিল লোকাল ট্রেন৷ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর ১১ নভেম্বর ফের শুরু হয় পরিষেবা৷ এ বার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দিতে দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে৷ শুক্রবার সন্ধ্যার হিসেব অনুযায়ী, রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণ ১৯ হাজার পার করেছে৷ মৃত্যু একশোর উপরে৷ পরিস্থিতি সামলাতে বৃহস্পতিবার থেকে লোকাল ট্রেন দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার৷ তার সুফল কি মিলবে?
দূরত্ববিধি নেই
একদিকে ট্রেন বন্ধ৷ অন্যদিকে বাসের সংখ্যা কমেছে অনেকটাই৷ মেট্রোও চলাচল করছে কম৷ অথচ সরকারি-বেসরকারি দফতর বন্ধ হয়নি৷ ৫০ শতাংশ কর্মী নিয়ে সরকারি দফতর চলছে৷ সেজন্য কর্মস্থলে পৌঁছতে নাজেহাল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে বাস ও মেট্রো চালানোর অনুমতি দিয়েছে রাজ্য৷ পথে নেই পর্যাপ্ত বাস, তার উপরে বাড়তি যাত্রীর চাপ৷ কোথাও দেখা যাচ্ছে লম্বা লাইন, কোথাও বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস যাচ্ছে মানুষ৷ কাজের জায়গায় পৌঁছনোর তাড়ায় উধাও সব নিয়মবিধি৷ মেচেদা, মধ্যমগ্রাম, বারুইপুর, ডানলপ, কামালগাজি, চুঁচুড়া— সর্বত্র ধরা পড়ল একই ছবি৷
তারাপদ হালদার শ্রীরামপুর থেকে নিয়মিত কলকাতায় আসেন৷ ট্রেন না পাওয়ায় বাসের উপর ভরসা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘নিজস্ব যানবাহন নেই৷ ফলে বাসে সংক্রমণের ভয় জেনেও উঠতে বাধ্য হলাম৷ এর থেকে লকডাউন হলে ভাল ছিল৷’’ একই অভিজ্ঞতা মধ্যমগ্রামের দীক্ষা রাউতের৷ সল্টলেকের কর্মস্থলে পৌঁছতে বেশ কিছুটা পথ ট্রেনে সফর করতেন৷ এখন তা সম্ভব হচ্ছে না৷ অ্যাপ ক্যাবে বিপুল ভাড়া কতজন মেটাতে পারবেন!
উল্টো ছবিটাও দেখা যাচ্ছে পথেঘাটে৷ অফিসের সময় ছাড়া দুপুর বা রাতে ফাঁকাই চলছে বাস৷ হাতে গোনা যাত্রী থাকছেন৷ তাই বেশি সংখ্যায় বাস চালাতে চাইছে না বাস মালিক সংগঠন৷ জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটের সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যত বেশি বাস চালাব, তত ক্ষতির বহর বাড়বে৷ জ্বালানির দাম বেড়েছে৷ বাসের ইএমআই, বিমার খরচ আছে৷ সরকারি বাস ভর্তুকি পায়৷ আমরা তো পাই না৷ কীভাবে বাসকর্মীদের পেট চলবে?’’
রুটি-রুজির সংকট
ভারতের অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা লেগেছে কোভিডের প্রথম দফায়৷ সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে গেছেন৷ দ্বিতীয় ঢেউয়ে তীব্র হচ্ছে অর্থনীতির সংকট৷ এরিমধ্যে ৭২ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন৷ শুধু এপ্রিলে কর্মহারা হয়েছেন ২৮ লাখ৷ এরমধ্যে বিপুল সংখ্যক নারীরাও রয়েছেন৷ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পূর্ণ লকডাউন চলছে৷ পশ্চিমবঙ্গ আংশিক লকডাউন করায় কি একটু ভালো অবস্থানে থাকবে? অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আংশিক করে লাভ হয় না৷ এতে যেমন সংক্রমণের শৃঙ্খল পুরো ভাঙা যায় না৷ তেমনই কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হতে থাকে৷ তার থেকে পূর্ণ লকডাউন ভালো যাতে অতিমারির থেকে বাঁচা যায়৷’’ যদিও কোনও লকডাউনকেই ফলপ্রসূ বলে মনে করেন না চিকিৎসকদের একাংশ৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম-এর সদস্য ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিকাকরণ জরুরি৷ তবেই কোভিডকে রোখা যাবে৷ লকডাউনে অতিমারির মোকাবিলা করা যায় না, উল্টো মানুষের বিপদ বাড়ে৷’’
তবে গোড়ায় মধ্যমপন্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ৷ কোভিড প্রোটোকল মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক, চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অতিমারি মোকাবিলা ও অর্থনীতির স্বাস্থ্য একসঙ্গে বিবেচনা করতে পদক্ষেপ নিতে হবে৷ ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে৷ তার সঙ্গে টিকাকরণ চালিয়ে যাওয়া দরকার৷ সবশেষ অস্ত্র লকডাউন৷ নইলে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়বেন৷’’