1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এবার প্রতিবেশীদের জন্য অঙ্কটা অত সরল নয়

এ কে এম খাদেমুল হক
২০ আগস্ট ২০২১

‘১৯৭১ আমি দেখিনি৷ কিন্তু তালিবানদের বিজয় দেখে অনুমান করতে পারছি, পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার পরের অনুভূতিটা কেমন ছিল৷' সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের মন্তব্য এটি৷

https://p.dw.com/p/3zHJm
ছবি: Rahmat Gul/AP/picture alliance

আফগানিস্তানে তালেবানদের সাম্প্রতিক উত্থান তার মতো অনেককেই উচ্ছ্বসিত করেছে৷ মুদ্রার উল্টোপিঠও দৃশ্যমান, অনেকেই আবার তালেবানদের বিজয়ে শঙ্কিত৷ সেই শঙ্কা যতোটা না আফগানিস্তানের নাগরিকদের, বিশেষ করে নারীদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে, তারচেয়েও বেশি এই বিজয়ের পথ ধরে বাংলাদেশে নতুন করে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কি না সেটা ভেবে৷

বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার জায়গাটা আসলে এখানেই৷ নইলে, প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের একটা দেশ, যে দেশে যেতে হলে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দুটি দেশ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয়, আর যে দেশের সঙ্গে জন্মের ৫০ বছরে কখনোই বাণিজ্যিক সম্পর্কটা ঠিক গড়ে ওঠেনি, সেই দেশে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ঢেউ বাংলাদেশে আছড়ে পড়ার তেমন কোনো কারণ নেই

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের জন্যও কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক একই রকম নয়৷ আফগানিস্তানের নিকটতম প্রতিবেশি পাকিস্তান তো বরাবরই তালেবানদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত৷ পঁচিশ বছর আগে প্রথমবার যখন তালেবানরা ক্ষমতা দখল করেছিল, তখন যে তিনটি মাত্র দেশ তাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল পাকিস্তান৷ পঁচিশ বছরে পাকিস্তানের রাজনীতিতেও অনেক পট পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু আফগানিস্তান প্রশ্নে তাদের অবস্থান যে খুব একটা বদলায়নি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতিক্রিয়া থেকেই সেটা স্পষ্ট৷ আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের চলে যাওয়া এবং তারপর চোখের পলকে তালেবানদের ক্ষমতা দখলকে পাকিস্তানের জন্য এক রকম নৈতিক বিজয় বলেই দৃশ্যত মনে হয়৷ ক্ষমতা দখলকে পাকিস্তানের জন্য এক রকম নৈতিক বিজয় বলেই দৃশ্যত মনে হয়৷ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক সময় ভারতকে রুশ বলয়ের আর পাকিস্তানকে মার্কিন ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হতো; বাস্তবে ছিলও তা-ই৷ কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা উপস্থিতির দুই দশকে খুব ধীরে ধীরে সেই চিত্রটা অনেকটাই বদলে গেছে৷ নানা কারণে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান মিত্রতা পাকিস্তানের জন্য অস্বস্তির কাঁটা হয়ে উঠছিল৷ আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার সেই অস্বস্তি খানিকটা হলেও কমিয়েছে৷

কিন্তু তালেবানদের সাম্প্রতিক উত্থানকে অতো সরল অঙ্ক হিসেবে দেখা ঠিক হবে না৷ কারণ, এবার তালেবানরা ঠিক দুই যুগ আগের মতো অপরিণত আচরণ করছে না৷ সেবার যেসব কারণে তারা মিত্রহীন, একঘরে হয়ে পড়েছিল, এবার যে সেই ভুলগুলো তারা করতে চাইছে না, ক্ষমতা দখলের প্রথম কয়েকদিনেই সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা৷ এমন নয় যে নিজেদের কট্টরপন্থী ধর্মীয় অবস্থান খুব একটা বদলেছে, কিন্তু রাজনৈতিক পরিপক্কতার ছাপ দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে৷ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা, তড়ি-ঘড়ি করে সরকার গঠন না করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ নানা পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা এবং বিশেষ করে নারীদের সরকারে প্রতিনিধিত্ব রাখার ঘোষণা সেই পরিপক্কতার লক্ষণ

কেবল দেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও এবার তারা পা ফেলছে খুব সতর্কভাবে৷ আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার কিন্তু আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়৷ জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট সরকার এটা বাস্তবায়ন করছে, কিন্তু বছর দেড়েক আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান সরকারের আমলেই শুরু হয়েছিল এই প্রক্রিয়া৷ গত ফেব্রুয়ারির সেই দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও চুক্তি স্বাক্ষরের পর মাঝের সময়টা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে তালেবানরা৷ মার্কিন সমর্থিত সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা ও দুর্নীতিকে কাজে লাগিয়ে এক দিকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেদের পক্ষে জনমত গড়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছে তারা৷ অন্য দিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মিত্রের সন্ধানও চালিয়ে গেছে৷ বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ায় প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে কুটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেছে, আর বৈশ্বিক রাজনীতির মারপ্যাঁচকে কাজে লাগিয়ে তাতে বেশ খানিকটা সফলও হয়েছে৷ বিশেষ করে চীনের বন্ধুত্ব পাওয়ার বিষয়টি আফগান সংকটের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে৷ গত অর্ধশতাব্দী ধরে চলমান এই সংকটের শুরুর দিকে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, পরবর্তীতে ঠিক একই ভূমিকায় দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে৷ আরেক পরাশক্তি চীন এতদিন এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মর্যাদার লড়াই ছাড়াও এখন আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আরও কারণ তৈরি হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির উদীয়মান এই নয়া মোড়লদের৷ খনিজ সম্পদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্ব তো আছেই; নিজেদের দেশে বিচ্ছিন্নতাকামী উইগুর মুসলিমদের ওপর তালেবান প্রভাব নিয়ন্ত্রণও তাদের জন্য এক চ্যালেঞ্জ বটে৷

নিজেদের বন্ধুত্বের বিনিময়ে উইগুরদের থেকে তালেবানদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে তাদের লাভ৷ আর কাবুলের পতনের পর অন্য সব দেশ তাদের কুটনীতিকদের সরিয়ে নিলেও চীন (এবং রাশিয়াও) তা না করে বুঝিয়ে দিয়েছে, এবার আর তারা নীরব দর্শক হিসেবে থাকছে না৷ অন্যদিকে তালেবানরাও যে আর কেবল পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ঘরে হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে না, সেটাও পরিষ্কার৷ আগেরবার পাকিস্তান ছাড়া কেবল সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বীকৃতি পেয়েছিল তারা৷ পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এমনিতেই আরো অন্তত দুটি দেশের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাদের; তুরস্ক ও ইরান৷ সঙ্গে চীন ছাড়াও এক সময়ের প্রবল প্রতিপক্ষ রাশিয়ার মিত্রতা অর্জনের প্রবল সম্ভাবনা দেখাচ্ছে তারা৷ তাই তাদের বিজয়কে নিজেদের অর্জন ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই পাকিস্তানের৷ এমনিতেও তাদের এই মিত্রদের সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে সংকট রয়েছে আগে থেকেই, পাখতুন অঞ্চলে দুই দেশের সীমান্তরেখা কখনোই মেনে নেয়নি তালেবানরা৷ আর স্বাধীনচেতা, বহুগোত্রে বিভক্ত আফগানরা যে কাউকেই স্থায়ি শত্রু বা মিত্র হিসেবে মানে না, প্রথমে রুশ ও পরে মার্কিনিদের অভিজ্ঞতা থেকেই সেটা স্পষ্ট৷ আফগানিস্তানের রাজনীতিতে নাক গলানোর আগে চীন-পাকিস্তান দুই দেশেরই সেটা মনে রাখা উচিৎ; নইলে তাদেরও একই রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতে পারে৷

সেই তুলনায় ভারতের অবস্থান অনেকটাই নিরাপদ বলা যায়৷ আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের সীমান্ত নেই; দৃশ্যত কোনো স্বার্থও নেই৷ অনেকটা বাংলাদেশের মতোই৷ কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় তাদের মাথাব্যথাটা অনেক বেশি৷ কারণটা ঐতিহাসিক৷ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের দুই প্রবল প্রতিপক্ষ পাকিস্তান আর চীন যেখানে জড়িত, সেখানে ভারতের স্বার্থ তো থাকবেই, পরোক্ষে হলেও৷ তাছাড়া তালেবানের সঙ্গে তাদের পুরনো শত্রুতাও আছে একটা- আগেরবার ক্ষমতায় থাকাকালে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছিনতাইকারীদের সহযোগিতা করেছিল বলেই মনে করে ভারত৷ অন্যদিকে বুরহানউদ্দিন রব্বানী-আহমেদ শাহ মাসুদের নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সঙ্গে ঐতিহাসিক মিত্রতা রয়েছে তাদের, তালেবানের সঙ্গে যাদের আবার শত্রুতার সম্পর্ক৷ সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা৷ ভারতের সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া কিংবা না দেয়া৷

তবে এখানেই শেষ নয়৷ ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে৷ আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও চীনের প্রভাব বৃদ্ধি দৃশ্যত অস্বস্তি তৈরি করলেও মোদী সরকারের জন্য সেটা শাপে-বর হয়ে উঠতে পারে; যে ধর্মীয় আবহ বিজেপির মূল শক্তি, আঞ্চলিক রাজনীতিতে যুদ্ধের দামামা বাজলেই তো সেটা জোর পায়৷ লস্কর-ই তৈয়বার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো তালেবানদের উত্থানে উজ্জীবিত হতে পারে অবশ্যই, কিন্তু সেই ধূয়া তুলে সেটাকেই নির্বাচনের মাঠে তুরুপের তাস প্রমাণ করার সুযোগও তো থাকছে!

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা একই রকম নয়? লেখার শুরুতে তুলে ধরা বাংলাদেশি নেটিজেনদের প্রতিক্রিয়া থেকেই অনুমান করা যায়, এখানে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামি ভাবধারা সাম্প্রতিককালে বেশ জোরালো হয়ে উঠছে৷ তালেবানদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীর উচ্ছাসের পেছনে আসলে আছে সেই ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় প্রভাব৷ এটা যে একেবারে নতুন, তা-ও কিন্তু নয়৷ সেই সোভিয়েত আগ্রাসনের যুগেই তো বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক আফগান মুজাহেদিনদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও গিয়েছিল! সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসাদের কারো কারো হাত ধরেই এই দেশে বিকাশ লাভ করেছে ইসলামি জঙ্গিবাদ৷ তাই নেটিজেন সমাজে তালেবানপ্রীতির ঝড় এক ধরনের সতর্কবার্তা তো দেয়ই৷ কিন্তু প্রকৃত অর্থে, আফগান সংকট বাংলাদেশ কিংবা সার্ক অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ওপর কখনোই প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব তৈরি করেনি, তালেবানদের নব-উত্থানও করবে বলে মনে হয় না৷