কিন্তু এই কথাটাই কিছু মানুষ বোঝেন না, কিংবা বুঝলেও মনে রাখেন না৷ সব কিছুতেই দেশের, ধর্মের, বর্ণের, জাতের বা মতের অমিল বড় করে তুলে বিষোদগারে আনন্দ খোঁজেন তারা৷
বাংলাদেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার সময় তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অনেকে৷ তার আত্মার শান্তি কামনাও করেছেন৷ কিছু মানুষের তা সহ্য হয়নি৷ একজন মুসলিম কেন একজন খ্রিস্টানের আত্মার শান্তি কামনা করলো- এই প্রশ্ন তুলে অনেক আপত্তিকর, অনেক আক্রমণাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তারা৷
এটা নতুন কিছু নয়৷ প্রায় সব দেশে, সব ধর্মেই এমন কিছু মানুষ ছিল এবং আছে৷
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা তো আছে দীর্ঘদিন ধরে৷ এটা বেশি প্রকাশ পায় কিছু হিন্দুর মুসলিম বিদ্বেষ এবং কিছু মুসলিমের হিন্দু বিদ্বেষে৷
এমন মানুষদের বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম৷ একবার বিষয়টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও কথা হয়েছিল তাঁর৷ সেই কথোপকথনের বিষয়টি এক লেখায় নজরুল উল্লেখ করেছিলেন এভাবে, ‘‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে৷ গুরুদেব বললেন: দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?''
আবার এমন নয় যে, এমন উগ্র মানুষ শুধু অন্য ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধেই সক্রিয়৷
গতকাল আয়মান সাদিককে নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডয়চে ভেলে৷ প্রতিবেদনটি ফেসবুকে পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ‘টেন মিনিট স্কুল'-এর প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে বিষোদগার৷ আয়মান সাদিকের অভিযোগ, তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ তার দাবি, সমকামিতার পক্ষে দেয়া আলোচিত স্ট্যাটাসটি তার ‘এক ভিনদেশি, ভিনবিশ্বাসী' সাবেক সহকর্মীর৷ তারপরও দায় না এড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি৷ তারপরও চলছে বিষোদগার আর হুমকি৷
আয়মান সাদিক বলছেন, তিনি মুসলিম, তার ‘টেন মিনিট স্কুল' কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, সেখান থেকে কোনো ধর্মের বিপক্ষে কিছু করা হয় না এবং ইসলামবিরোধী কোনো কাজই করা হয়নি৷ তিনি আরো বলেছেন, তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠান তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে থাকলে সেজন্যও তিনি ক্ষমাপ্রার্থী৷
তার বক্তব্যের ভিডিওটি যে কেউ দেখতে পারেন, শুনতে পারেন৷ দেখে, শুনে অন্যায় বা সমালোচনাযোগ্য কিছু পেলে সমালোচনাও করতে পারেন৷ তাই বলে হত্যার হুমকি! এমন হুমকিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন!!
আসলে বরাবরের মতো এখনো কিছু মানুষ ধর্মের উদারতার দিকটাই ভুলে বসে আছেন৷
অথচ উদার মানুষ সব ধর্মে, বর্ণে, জাতিতে ছিল এবং আছে বলেই পৃথিবীটা বাসযোগ্য ছিল এবং এখনো আছে৷
ভেদাভেদটাকে বড় করে দেখেননি এমন উদার মানুষেরা সবসময় অন্য ধর্মেরও উপকার করেছেন৷
মাত্র দু'জন বাঙালির কথা বলি৷
একজন গিরিশ চন্দ্র সেন৷ কেউ তাঁকে বলতেন ‘ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন', আবার কারো কাছে তিনি ছিলেন ‘‘মৌলভী গিরিশ চন্দ্র সেন'৷ তাকে মৌলভী বলা হতো, কারণ, অমুসলিম হয়েও পবিত্র কোরান শরিফের প্রথম বঙ্গানুবাদ করেছিলেন তিনি৷
আরেকজন বিদ্রোহী কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিশ্বমানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম৷
তার মতো ভালো ইসলামি গান আর কেউ লিখতে পারেননি৷ আবার তার মতো ভালো শ্যামা সংগীত লেখার সাধ্যও আর কারো হয়নি৷
‘মুনাজাত' কবিতায় তিনি লিখেছেন:
আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভু উদার,
হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর৷
যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাহি নীচতার৷৷
ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র-পর৷
নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
ক্ষুদ্র আত্মা তার৷৷
কিন্তু তাঁর এমন উদারতা কিছু হিন্দু এবং কিছু মুসলমানের তখন একেবারেই পছন্দ হয়নি৷ সেই মানুষগুলো ধর্মের প্রকৃত বাণী ভুলে হিংসা, ঘৃণা, মারামারি, হানাহানির পক্ষেই নিজেদের অবস্থান জানাতো নানাভাবে৷
তাদের কথা ভেবে নজরুল ‘ক্ষমা করো হযরত' কবিতায় লিখেছেন:
তোমার বাণীকে করিনি গ্রহণ
ক্ষমা করো হযরত
ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ
তোমার দেখানো পথ
ক্ষমা করো হযরত৷
বিলাস বিভব দলিয়াছ পায়
ধুলিসম তুমি প্রভু
তুমি চাহো নাই আমরা হইব
বাদশাহ, নওয়াব কভু৷
এই ধরণীর ধন সম্পদ
সকলের তাহে সম অধিকার,
তুমি বলেছিলে ধরণীতে সবে
সমান পুত্রবৎ
ক্ষমা করো হযরত৷
তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীদের
তুমি ঘৃণা নাহি করে,
আপনি তাদের করিয়াছ সেবা
ঠাঁই দিয়েছ তুমি ঘরে৷
ভিন্ন ধর্মীর পূজা মন্দির
ভাংতে আদেশ দাওনি, হে বীর!
আমরা আজিকে সহ্য করিতে
পারিনা পর মত,
ক্ষমা করো হযরত৷
তুমি চাও নাই ধর্মের নামে
গ্লানিকর হানাহানি,
তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে
দিয়াছ অমর বাণী৷
মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা
সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা,
বেহেশত থেকে ঝরে নাকো আর
তাই তব রহমত,
ক্ষমা করো হযরত৷