জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবিতে অস্বস্তিতে বিজেপি
১৭ ডিসেম্বর ২০২০প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ বিজেপি নেতৃত্বের মুখে ইদানীং ঘনঘন শোনা যাচ্ছে বাংলার মনীষীদের নাম৷ শুধু স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নন, শোনা গিয়েছে ঋষি অরবিন্দ ঘোষ থেকে বিস্মৃতপ্রায় কবি মনোমোহন বসুর নাম৷ এর মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘বহিরাগত’ তকমা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে বিজেপি, এমনই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের৷ এরই মধ্যে দলকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছেন সুব্রমনিয়ম স্বামী৷ তিনি বলেছেন, জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ বদলে ফেলা হোক৷ তার বদলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গীতকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি৷
এই গান নিয়ে ঠিক কোথায় আপত্তি স্বামীর? প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বিজেপি নেতা বলেছেন, ‘‘জাতীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত সিন্ধু শব্দটির কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই৷ এ ছাড়া এই গানে এমন কয়েকটি শব্দ আছে যা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যার কোনো অর্থ নেই৷ গানটি কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে, সেটাও স্পষ্ট নয়৷'' এর পরিবর্তে স্বামী ১৯৪৩ সালে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের গাওয়া ‘শুভ সুখ চ্যায়েন' গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করার অনুরোধ করেছেন৷ স্বামীর পাঠানো চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ এরপরই শুরু হয়ে গিয়েছে বিতর্ক৷ তা হলে কি প্রধানমন্ত্রী সত্যিই এই প্রস্তাব বিবেচনা করছেন?
দ্রুত এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ তারা প্রচার করছে, বিজেপির কাছে যে বাঙালি ভাবাবেগের কোনো মূল্য নেই, তা এই প্রস্তাব থেকেই প্রমাণিত৷ এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় জাতীয় সঙ্গীত বদলের ভাবনা-চিন্তার তীব্র বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, ‘‘ওরা একবার জাতীয় সঙ্গীত বদলে দেখুক না, ওদেরই উল্টে দেব৷’’ মুখ্যমন্ত্রীর কড়া চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মুখ খুলেছেন বিদ্বজ্জনেরা৷ চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বরাবরই বিজেপির সমালোচক৷ তিনি বলেছেন, ‘‘জাতীয় সঙ্গীত না বদলে কেন্দ্রীয় সরকার বদলে ফেলা হোক৷ রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি ঠিক থাকে, তবে সংস্কৃতির রাজনীতিও যথাযথ থাকবে৷’’
‘সিন্ধু’ শব্দটি নিয়ে বিজেপি নেতার আপত্তি খারিজ করে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডল৷ তার বক্তব্য, ‘‘সিন্ধু প্রদেশ ভারতীয় ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত৷ গানে তার প্রতিফলন রয়েছে৷ সেই ইতিহাস মুছে ফেলা যায় নাকি? সংস্কৃত এখন আর ব্যবহারিক জীবনে প্রাসঙ্গিক নয়, তা হলে সেই ভাষার গুরুত্ব অস্বীকার করতে হয়৷ তাই কয়েকটি শব্দ তুলে ধরে গান বদলের দাবি অর্থহীন৷’’
পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজ্য বিজেপি এই প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে৷ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে রাজনৈতিক উত্তাপ যখন তুঙ্গে, যখন ‘বহিরাগত’ তকমা ঝেড়ে ফেলতে বাংলার মনীষীদের কথা বারবার বলছেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব, তখন স্বামীর এই প্রস্তাব অস্বস্তিকর বটে৷ বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, ‘কোনো বিষয়ে যে কেউ প্রস্তাব পাঠাতে পারেন৷ তার মানে সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত নয়৷ তৃণমূল এটা নিয়ে অকারণ হইচই করছে৷’’ বরং বিজেপি নির্বাচনের আগে আরো বেশি করে বাঙালির ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়েছে৷
বাঙালির আবেগকে উস্কে দিতে কোনো চেষ্টার কসুর করছে না কেন্দ্রীয় সরকার৷ তারা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন সাড়ম্বরে পালনের উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু করেছে৷ ২০২২ সালে নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী৷ সেই অনুষ্ঠান আগামী ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে শুরু করে দিতে চাইছে কেন্দ্র৷ তারা ইতিমধ্যেই সরকারি উদযাপনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে৷
কিন্তু স্বামীর প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের মূল আদর্শকে জুড়ে দেখছেন মননকুমার মণ্ডল৷ তিনি বলেন, ‘‘যারা জনগণমন পরিবর্তনের দাবি তুলছেন, তাঁরা ভারতীয় বহুত্ববাদের বিরোধী৷ জাতীয় সঙ্গীতে বিবিধের মাঝে মিলনের যে ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়েছে, আদর্শগতভাবে তার বিরোধী৷ রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন৷ সেই ভাবনা মুছে দিতে চাইছে রাজনীতিকদের একটা অংশ৷’’