জার্মানিতেও জল জমে, গ্রামগঞ্জ বানে ভাসে
৪ জুলাই ২০১৭জলাবদ্ধতা বলতে যদি বর্ষায় রাস্তাঘাটে জল জমে গাড়ির বনেট ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা বোঝায়, তাহলে তা জার্মানিতে বেশি ঘটে না৷ তার প্রথম ও প্রধান কারণ এ দেশের সমৃদ্ধি৷ শহর তৈরি করার আগে ও পরে এরা সেই শহরের পয়ঃপ্রণালী থেকে শুরু করে, পানি নিষ্কাশন ও ময়লা পানি পরিশোধনের দিকে নজর রাখে৷ আগে থেকে পরিকল্পনা করে৷ তারপর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ত বিভাগ তৎপর হয়, নির্মাণকার্য চলে৷ বর্ষা হলে রাস্তায় যে জল জমবেই, সেটাই যে বিধাতার নির্দেশ, এটা মেনে নিতে এ দেশের মানুষের দ্বিধা আছে এবং ছিল চিরকাল৷
ভারি বর্ষা এদেশেও হয়৷ ঠিক আমাদের দেশের মতো না হলেও, ছোট্ট মহাদেশ ইউরোপের উত্তর ও পশ্চিম থেকে ঋতু অনুযায়ী ঝড়বাদল এসে হানা দেয়, অকারণে প্রবল বৃষ্টি হয়৷ এদের মাপজোক করে তৈরি করা পানি নিষ্কাশন প্রণালীর মুখে ছাই দিয়ে সেই ঘণ্টা খানেক, ঘণ্টা দেড়েকের বৃষ্টিতেই দেখেছি, বাড গোডেসবার্গের কাছে রেললাইনের নীচে গাড়ি যাবার টানেল জলে ভরে গেছে – সে আবার গাড়ি-ডোবা জল! গাড়ি ব্যাক করে কোনোমতে লোকজন পালানোর পথ খুঁজছে৷ অথচ সে যা বৃষ্টি, তাতে কলকাতায় আমাদের গর্চা রোডের পিচ ঢাকত কিনা সন্দেহ৷ সভ্য দেশে কেন এমন হয়?
পরে বুঝলাম, সভ্য দেশ বলেই হয়৷ এসব দেশে সব কিছু হয়, হিসেব করে হয় – মানে হওয়া উচিত৷ কিন্তু বৃষ্টিবাদলকে তো আর কেউ সভ্য-অসভ্য শিখিয়ে দেয়নি, ‘ছি বাবা, বন শহর, হাজার হোক জার্মানির সাবেক রাজধানী, এখানে অমন তুমুল বৃষ্টি করলে চলে? অত জল যাবে কোথায়?' ‘কেন, রাইন নদে...৷' ‘রাইনও তো পানিতে ভরে আছে, সুইজারল্যান্ডে বরফ গলেছে কিনা৷ তায় আবার ঊনবিংশ শতকে রাইনের ধারগুলো কেটে সোজা করে দেওয়া হয়েছিল, নয়ত তোমার রাইনও তো ছিল আমাদের ছোট নদী চলে এঁকে-বেঁকে, তার মতন৷'
‘তারপর?' ‘রাইনে বন্যার জল এলে অতীতে তার পাশে যেসব ফাঁকা মাঠ বা জলাভূমি আছে, সেগুলো সেই জল ধরে রাখতো৷ পরে বাড়ি, বাগান, হাওয়া খাবার স্ট্র্যান্ড ইত্যাদি বানিয়ে রাইনের কাছ থেকে তার সেই রাইনাউয়ে বা রাইনের চর কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ তাই রাইনের জল এখন সাঁ সাঁ করে বন-কোলন-ড্যুসেলডর্ফে পৌঁছে যায়; যেখানে পারে পাথরের দেয়াল টপকে বিশেষ করে শহরে পুরনো অংশগুলোকে ডুবিয়ে দেয়, বাড়িঘরে জল ঢোকে, লোকজন জেরবার হয়৷' ‘কিন্তু তা বলে রাস্তায় জল জমবে?'
‘আহা-হা, রোজ কি জমে? বললাম না, মিউনিসিপালিটির হিসেবে নেই, এমনধারা বৃষ্টি হলে, তবেই জমে৷ যখন রাস্তার ম্যানহোলের ভেতর থেকে জল বেরোতে শুরু করে আর কি! ও হ্যাঁ, শুধু বৃষ্টিবাদলাই নয়, মাঝেমধ্যে মাটির নীচে জলের পাইপ ফেটে রাস্তা ভেসে যায়৷ ভেসে যায় মানে ধরো হাঁটুজল – তাতেই কিন্তু এদেশে উর্দি পরা দমকলের লোক এসে রাবারের ডিঙিতে করে বুড়োবুড়িদের শুকনো ডাঙায় নিয়ে যায়৷'
‘ঠাট্টা করছ?'
‘আমার ঘাড়ে ক'টা মাথা! তবে একবার গাড়িতে ইটালি থেকে সুইজারল্যান্ড হয়ে জার্মানিতে ফেরার সময় দেখেছিলাম – দু'পাশের পাহাড় থেকে একটির পর একটি জলধারা নামছে, ঠিক যেন জলপ্রপ্রাতের মতো! সে কি জল, যেন অটোবান – মানে মোটরওয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে৷ ঐ জলই তো আস্ত জার্মানি বেয়ে ধেয়ে আসে বন শহরের দিকে৷ ওদিকে দেড় শতাব্দী ধরে নদী দখল চলেছে, রাইনের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই৷ তাই সাঁওতাল বিদ্রোহের মতো রাইন তার ঘোলা জল নিয়ে ঢুকে পড়ে তার আগের সেই উন্মুক্ত চারণভূমিতে৷ বেচারা বন শহরের কথা ভাবো: দু'পাশে পাহাড়, মাঝখানে ভরভর্তি রাইন, তার ওপর আবার বৃষ্টি৷ তা বানভাসি হওয়ার চেয়ে পানিবন্দী হওয়াই ভালো, নয় কি?'
‘আর দুরমুশের কথা কী বলছিলে?'
‘জার্মানিকে দেখলে আমার চিরকাল মনে হয়, বড় ঘরের ভালো ছেলে: মা যেন গাল টিপে, মাথা আঁচড়ে, পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে৷ এখানকার বনভূমি পর্যন্ত সাইজ করে৷ মুশকিল এই যে, সেই বনভূমিতে সব কাজ হয় ভারী ভারী ট্রাক্টর দিয়ে৷ সেই সব ট্রাক্টরের চাপে বনের মাটি যেন দুরমুশ দিয়ে পিটে শক্ত হয়ে যায়, পানি যেতে পারে না৷ তাই বৃষ্টির জল পাহাড়ের ঢালের বন বনানী থেকে সর সর করে নেমে আসে নীচে শহর আর নদীর দিকে৷ ওদিকে শহর জুড়ে শুধু বাড়ি আর রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সেখানেও পানি যাবার পথ নেই৷ জার্মানির ১২ শতাংশ জমি শহর, তার আবার অর্ধেক এইভাবে ‘সিলড', অর্থাৎ সিল করে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ওদিকে শহুরে বসতি বাড়ছে দিনে ১৩০ হেক্টার করে৷'
‘তাহলে উপায়?'
‘চলো রাইনের ওপর খানিকটে নৌকোবিহার করে আসা যাক৷'
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷