1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারী সাংবাদিককে ‘চরিত্রহীন' বলে মইনুল কারাগারে

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৩ অক্টোবর ২০১৮

লাইভ অনুষ্ঠানে নারী সাংবাদিককে ‘চরিত্রহীন বলেছিলেন তিনি৷ তারপর পাঁচটি মামলা হলেও গ্রেপ্তার হয়েছেন রংপুরে করা ষষ্ঠ মামলায়৷ সুবাদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল এখন কারাগারে৷

https://p.dw.com/p/372WP
Bangladesch Dhaka - Barrister Mainul Hossain, wegen Verleumdungsklage des Journalisten Masuda Bhatti festgenommen
ছবি: bdnews24

টক শো-তে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে রংপুরে একটি মানহানির মামলা দায়ের করেছেন একজন নারী মানবাধিকারকর্মী৷

এর আগেও তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা হয়েছে৷ সবগুলোতেই জামিনে ছিলেন তিনি৷ সোমবারের ওই মানহানির মামলায় রাতেই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ৷ এই মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে তাকে (ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন) কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) কায়সারুল ইসলামের আদালতে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন বিচারক৷

রংপুরে মামলাটি করেছেন মানবাধিকারকর্মী মোছাম্মৎ মিলি মায়া৷ যে ঘটনায় তিনি সরাসরি জড়িত নন, সেই ঘটনায় তাঁর মামলায় উদ্যোগী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘একজন নারীর প্রতি যে অসম্মান করা হয়েছে, এ কারণেই একজন নারী হয়ে আমি এই মামলা করেছি৷ মইনুল হোসেন যে অসম্মান করেছেন মাসুদা ভাট্টিকে, সেটা তার একার অপমান না৷ সেটা পুরো নারী সমাজের অপমান৷'' কয়েকদিন আগের ঘটনা এত পরে এসে কেন মামলা করলেন? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আপনি কি উৎসাহিত হয়ে মামলাটি করেছেন? এসব প্রশ্নের জবাবে মিলি মায়া বলেন, ‘‘এখানে কারো বক্তব্যে আমি উৎসাহিত হইনি৷ নিজের সিদ্ধান্তে মামলা করেছি৷ মামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে দেরি হয়েছে৷ আমি মনে করি, তার এমন শাস্তি হওয়া উচিৎ যাতে আর কেউ কোনো নারীকে অসম্মান করে এভাবে কোনো বক্তব্য দিতে না পারে৷''

‘মইনুল হোসেন যে অসম্মান করেছেন সেটা পুরো নারী সমাজের অপমান’

বিচারকের আদেশের পরপরই ব্যারিস্টার মইনুলকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল আলম জানান, ‘‘তাকে সাধারণ ওয়ার্ডে সাধারণ বন্দিদের মতো রাখা হবে৷'' মইনুল হোসেনের পক্ষে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার জামিন শুনানির শুরুতে বলেন, ‘‘স্যার, (বিচারক) মামলাটি কী এবং কোন ধারার মামলা, আমাদের কাছে কিছুই নেই৷'' তিনি বলেন, ‘‘স্যার, (বিচারক) আপনাকে আগে জানতে হবে এটা কী মামলা, জামিনযোগ্য ধারার, নাকি জামিন অযোগ্য ধারার৷জামিনযোগ্য ধারার হলে একরকম, আর জামিন অযোগ্য ধারার হলে আরেক রকম আদেশ দেবেন৷'' তখন বিচারক বলেন, ‘‘এটা রংপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মামলা, যার নম্বর ৭৯৭, দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার মামলা৷''

এরপর আসামি মইনুল হোসেনের পক্ষে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতের কাছে জানতে চান, মইনুলের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা আছে কিনা৷ এখানে অন্য থানার প্রসিকিউশনের পুলিশ দেখা যাচ্ছে৷ বিচারক বলেন, ‘‘না৷ ওনার বাসা ওয়ারি থানার এলাকায় হওয়ায় ওই থানার পুলিশ আছে৷ বাকিরা নিরাপত্তার জন্য৷'' সানাউল্লাহ মিয়া শুনানিতে আরো বলেন, ‘‘এ মামলার আসামি মইনুল হোসেনের পক্ষে শুনানি করবেন তার আপন মামা খন্দকার মাহবুব হোসেন৷ তবে এ মামলাটি একটি সিআর মামলা, বাদী মিলি মায়া বেগম৷ উনি মামলা করেছেন রংপুরে৷ মামলার ঘটনাস্থল হলো ঢাকা৷ ওইখানে তো বাদির কোনো মানহানি হয়নি৷ মাননীয় আদালতের কাছে আমরা জামিন চাই৷ যেহেতু তাকে দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, সেহেতু জামিনযোগ্য ধারায় তাকে জামিন দেওয়া আদালতের এখতিয়ার রয়েছে৷''

ঘটনার সূত্রপাত একাত্তর টেলিভিশনের টক শো ‘একাত্তর জার্নাল'-এ৷ সেখানে ব্যারিস্টার মইনুলের কাছে মাসুদা ভাট্টি জানতে চান, তিনি জামায়াতে ইসলামীর হয়ে জোটে অংশ নিচ্ছেন কিনা৷ মাসুদা ভাট্টি জানান, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে এমন একটি আলোচনা চলছে৷ কিন্তু প্রশ্নরে জবাব না দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল  মাসুদাকে ‘চরিত্রহীন' হিসেবে আখ্যায়িত করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন৷ পরের দিন মাসুদা ভাট্টিও মামলা করেন মইনুলের বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬টি মামলা হয়েছে সাবেক ত্ত্বাবধয়ারক সরকারের উপদেষ্টার বিরুদ্ধে৷ ৫টি মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন ব্যারিস্টার মইনুল৷

ব্যারিস্টার মইনুলের গ্রেফতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাসুদা ভাট্টি ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘একটি টেলিভিশনের লাইভ শো-তে তিনি এই মন্তব্য করেছেন৷আমি তাই প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছিলাম৷ তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ফোন করার পর আমি তাকে এই পরামর্শ দেই৷ কিন্তু তিনি সেটা করেননি৷ ফলে আমি সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছি৷ এখন বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে৷ আদালতই বিষয়টা দেখবে৷ আর বিষয়টা এখন আর আমার একার বিষয় নেই৷ এটা সারাদেশের নারী সমাজের বিষয়৷'' এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি রাজনীতি ঢুকে যায় তাহলে নারীদের সম্মান রক্ষার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা জানতে চাইলে মাসুদা ভাট্টি বলেন, ‘‘কোনোভাবেই ক্ষতিগ্র্স্ত হবে না৷ কারণ, নারীদের এই আন্দোলনে রাজনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন আছে৷ রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না৷ ফলে আমি এটাকে অন্যভাবে দেখি না৷''

‘ওনার গ্রেফতারের পর আমরা এখনো বসিনি’

মঙ্গলবার আদালতে শুনানির সময় পুলিশ ও আইনজীবীদের আদালতের ভেতরে প্রবেশ করা নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়৷ তখন আইনজীবীরা হট্টগোল শুরু করলে বিচারক শান্ত হতে বলেন৷ বিচারক বলেন, ‘‘নিরাপত্তার কারণে পুলিশ আদালতে বেশি লোক ঢুকতে দেয়নি৷ আর এখানে তো সিনিয়র আইনজীবীরা আছে৷'' মইনুল হোসেনের জামিনের বিরোধিতা করে আইনজীবী আবু আব্দুল্লাহ শুনানিতে বলেন, ‘‘উনি একজন নারী সাংবাদিককে চরিত্রহীন বলেছেন৷ এটা সবাই সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখেছেন৷ তিনি নারী সমাজকে কলঙ্কিত করেছেন৷'' কাজী নজিবুল্লাহ হিরু জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, ‘‘মইনুল হোসেন শুধু মাসুদা ভাট্টিকে অপমানিত করেননি, তিনি সারা নারী সমাজকে অপমানিত করেছেন৷ আজকে কিছু কিছু নারী অগ্রসর হচ্ছে, তাঁদেরকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন৷ এরপর ওনাকে বলা হলো, ‘আপনি মাফ চান'৷ উনি বলেছেন, ‘‘আমি পার্সোনালি ফোন করেছি৷'' তিনি পুরো নারীসমাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন৷ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পুরোসমাজ৷''

এর আগে সোমবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর উত্তরায় নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রবের বাসা থেকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ৷

গত ১৬ অক্টোবর বেসরকারি ৭১ টেলিভিশনের একটি টকশো-তে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে অশালীন ও আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগে নারী সাংবাদিক ও সম্পাদকরা বিবৃতি দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে মাফ চাইতে বলেন৷ তিনি এরপর দুঃখপ্রকাশ করে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইলেও তাকে প্রকাশ্যে মাফ চাওয়ার আহ্বান জানান তাঁরা৷ এরপর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করেন মাসুদা ভাট্টি৷ পরে দেশের বিভিন্ন জেলায় আরো মামলা দায়ের হয় তার বিরুদ্ধে৷

নবগঠিত ঐক্যফ্রন্টের শুরু থেকেই এর সঙ্গে আছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন৷ ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওনার গ্রেফতারের পর আমরা এখনো বসিনি৷ তবে আমার ব্যক্তিগত মত বলতে পারি, সেটা হলো, এটা নিয়ে একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে, এটা ঠিক৷ এর মধ্যে কোনোই পয়েন্ট নেই, সেটা বলব না৷ তবে বিতর্কটাকে যেভাবে চাউর করা হয়েছে, তাতে এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় অবশ্যই আছে৷ তবে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হলে মামলা করবেন, আদালত বিচার করবে৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন এটা নিয়ে মামলা করতে বলেন, তখন বুঝতে হবে এর মধ্যে প্রতিহিংসার বিষয় আছে৷ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে কারো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ দেখানো যাবে না৷ প্রধানমন্ত্রী বললেন এরপর মামলা হলো৷ তারপর রাতেই তাকে গ্রেফতার করা হলো৷'' এটা নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট কিছু ভাবছে কিনা জানতে চাইলে জনাব মান্না বলেন, ‘‘আমরা এখনো বসিনি৷ বসলে তখন বলা যাবে কী করছি৷''

‘আমি তাঁকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছিলাম, তিনি সেটা করেননি’

এদিকে মঙ্গলবার গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন একটা বিবৃতি দিয়েছেন৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘এ সময় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার অনাকাঙ্খিত৷ আমরা যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গাঠন করেছি, তা প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার অনুকূল৷ কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে আমরা উদ্বিগ্ন৷ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনার জন্যই আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গাঠন করেছি৷ সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে সুষ্ঠু রাজনীতির পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছি৷ বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি-গ্রেফতার অনাকাঙ্খিত৷''

অপরদিকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘‘যে ঘটনা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি রোধেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ মইনুলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে মামলার কারণে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে তার সংশ্লিষ্টতা এখানে কোনো বিষয় নয়৷'' আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও এ বিষয়ে কথা বলেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার আগে থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে টেলিভিশন টক শো-তে অনেক কথাই বলতেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন৷ কিন্তু তখন তো তাকে গ্রেফতার করা হয়নি৷ বরং সাম্প্রতিক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ এটার সঙ্গে রাজনীতি মেলানোর সুযোগ নেই৷''